ওয়েস্ট ইন্ডিজে সাকিব-তামিমদের ব্যর্থতা : বুলবুলের পোস্টমর্টেম
তিনিই বলেছেন-সাকিব, তামিম, মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকদের টেকনিকে তেমন কোন সমস্যা নেই। স্কিলে কোন ঘাটতি নেই। তাই যদি সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশ কেন দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নাকাল হলো? কেন এই চরম ব্যর্থতা?
বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে জাগো নিউজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্তব্যরত আমিনুল ইসলাম বুলবুল। রোববার বিকেলে মুঠোফোনে অস্ট্রেলিয়া থেকে জাগো নিউজের সাথে আলাপে সাকিব বাহিনীর টেস্ট পারফরমেন্সের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক কথাই বলেছেন জাতীয় দলের এ সাবেক অধিনায়ক।
তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে, টাইগারদের ওয়েস্ট ইন্ডিজে খারাপ খেলার নৈপথ্য কারণ। বুলবুলের কথা, ‘হয়ত অনেকে অবাক হয়ে থাকতে পারেন। তবে আমি কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমাদের জাতীয় দলের পারফরম্যান্সে খুব অবাক হইনি।’
তবে কি আপনি এমন অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সই আশা করেছিলেন? যদি সত্যিই আপনার মনে হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে চরম ব্যর্থ হবে। একপেশেভাবে টেস্ট সিরিজ হারবে, তাহলে কেনই বা সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না, কেন মনে হয় না টেকনিক বা স্কিলে ঘাটতি আছে?
জাগো নিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে আমিনুল ইসলাম বুলবুল অনেক লম্বা চওড়া, গোছানো জবাব দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পয়েন্ট আছে।
বুলবুলের উপলব্ধি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ এখন মোটামুটি অভিজ্ঞ দল। শীর্ষ ছয়-সাতজন ক্রিকেটার মিলে প্রায় হাজার ওয়ানডে খেলে ফেলেছেন। একই ভাবে মূল নির্ভরযোগ্য পারফরমাররা মিলে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাও হয়েছে পূর্ণ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে দলটি আমাদের সাথে খেলেছে, তাদের অভিজ্ঞতা অনেক কম। ক্যারিবীয়রা প্রায় অর্ধেক আন্তর্জাতিক খেলার দিক থেকে। কিন্তু সেই দলটির বিপক্ষে আমাদের প্রস্তুতি কার্যক্রমটা যেমন সাজানো-গোছানো আর সুপরিকল্পিত হওয়া উচিৎ ছিল, তা হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে দলটির সাথে টেস্টে মোকাবিলা হবে, সে দলটি কেমন? তাদের শক্তি-সামর্থ্য কতটা? খেলা হবে কেমন পিচে? তার চরিত্র কি? সেই পিচে আমাদের শক্তির জায়গা কি আর দুর্বলতা ও ঘাটতির জায়গাগুলোই বা কোথায়? এসব অনেক আগেই ঠিক করে রাখা উচিৎ ছিল।
কিন্তু সেই কাজটা কে করবেন? দলে প্রধান কোচই ছিলেন না। স্টিভ রোডস সবে এসেছেন। তাকে দোষ দেবার প্রশ্নই ওঠেনা। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ, কোচ একদম নতুন। অথচ সঙ্গে একজন ম্যানেজারও নেই। ক্রিকেট ম্যানেজার, লজিষ্টিক বা ট্যুর ম্যানেজার কিছুই নেই। এগুলোও খারাপ খেলার বড় কারণ।
তবে বুলবুলের আসল চোখ অন্য জায়গায়। তার প্রথম মূল্যায়ন হলো, অদূরদর্শি দল নির্বাচন, বিশেষ করে ঘুরে ফিরে সব ফরম্যাটে একই ব্যাটসম্যানদের ওপর নির্ভরতা রীতিমত ভোগাচ্ছে। এ সম্পর্কে বুলবুলের কথা, ‘বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ, যাদের তিন ফরম্যাটের চালিকাশক্তি ঘুরে ফিরে চার থেকে পাঁচ, উর্ধ্বে ছয়জন ক্রিকেটার।’
ব্যাটিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে বুলবুল বলেন, ‘দেখেন তামিম, মুমফিক, সাকিব আর মাহমুদউল্লাহসহ আরও জন দুয়েক ব্যাটসম্যান আছে; যারা ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির মত টেস্টেও ব্যাটিং স্তম্ভ। ব্যাটিংটা তাদের ওপরই নির্ভর করে।’
একই দল যখন ২০ ওভারের ম্যাচ খেলতে নামছে, তখনও তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহই প্রথম ও শেষ কথা। তারাই নির্ভরতা। আস্থার প্রতীক। ঠিক টেস্টেও পুরো ব্যাটিং তাদের ওপরই নির্ভর করে। এতে করে একটা বড় সমস্যা ভিতরে ভিতরে তৈরি হচ্ছে।
কি সেই সমস্যা ? বুলবুলের ব্যাখ্যা, ‘ঘুরে ফিরে হাতে গোনা কজন ব্যাটসম্যান তিন ফরম্যাটে দলের মূল ব্যাটিং শক্তির কেন্দ্র বিন্দু ও চালিকাশক্তি হয়ে পড়ায় হয়েছে কি তাদের ওপর বেশি চাপ পড়ছে। তারা যখন টি-টোয়েন্টি খেলছে, তখন মাথায় টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং স্টাইল, ধরন, মেজাজ ও গতি প্রকৃতি কাজ করছে। যখন ওয়ানডে খেলতে নামছে, তখন তারাই ভাবছে আমাকে ৫০ ওভারের ফরম্যাট অনুযায়ী ব্যাট করতে হবে। আবার ঠিক অল্প কদিন পর ঠিক তাদেরকেই পাঁচ দিনের খেলা টেস্ট নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে এবং মাঠে ১২০ বলের খেলার চিন্তা, কৌশল বাদ দিয়ে পাঁচ দিনের খেলার কথা ভাবতে হচ্ছে।’
বুলবুল মনে করেন, এই কারণেই খেলোয়াড়রা নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারছেন না। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক বলেন, ‘যেহেতু ঘুরেফিরে তারাই অল্প কজন, তাই এক ফরম্যাটের খেলা শেষ হতেই আবার অন্য ফরম্যাটে মাঠে নামার মানসিক ও ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ফরম্যাট ভেদে মেজাজ পাল্টানো সহজ নয়। কঠিন। কিন্তু ঘুরে ফিরে চার থেকে ছয়জন পারফরমারকে সারা বছর সেই কাজটিই করতে হচ্ছে। সেখানেই বিপত্তি ঘটছে।’
এছাড়া বুলবুলের ধারণা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা দক্ষিন আফ্রিকা সফরের আগে প্রস্তুতি কার্যক্রমটা যেমন সুবিন্যস্ত, সুচারু ও পরিবেশ উপযোগি হওয়া উচিত বা একান্তই জরুরি; তাও কম হয়। বা হয়ইনা। হয়তো এবারো হয়নি।
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বুলবুল বলেন, ‘আমি গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগেও বলেছিলাম, প্রস্তুতি নিতে হবে অনেক ভেবে চিন্তে। শুধু এক ঝাঁক হাই প্রোফাইল বিদেশি কোচ কাজ করবেন আর দুই মাসের বেশি সময় ধরে প্র্যাকটিস চললো, এর নাম প্রস্তুতি নয়। প্রস্তুতি হতে হবে পরিবেশ ও প্রতিপক্ষর সাথে মিল রেখে। আমরা কোথায় খেলতে যাচ্ছি ? সেই দেশের আবহাওয়া, উইকেট এবং কন্ডিশন কি এবং কেমন? আর যাদের সাথে খেলা, তারাই বা কেমন দল, তাদের গঠন শৈলি ও শক্তি-সামর্থ্য কেমন? এসব বিচার বিবেচনা করেই প্রস্তুতি নিতে হবে।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথমে শুরু হয়েছে টেস্ট দিয়ে। কিন্তু এই সফরের আগে ভারতের মাটিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। এমন অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত দলের ক্ষতি করছে, মনে করেন বুলবুল, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রতিপক্ষ-উইকেটের কথা চিন্তা করে প্রস্তুতি নেয়া হয় না। হলেও নেহায়েত কম। এই যেমন এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে আসার ঠিক আগে আমরা খেললাম টি-টোয়েন্টি । তাও আফগানিস্তানের মত দুর্বল দলের সাথে। খেলা হলো ভারতের দেরাদুনে। আফগান লাইন আপ, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট আর দেরাদুনের উইকেট-এই তিনটির একটির সাথেও কি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের কোন মিল আছে?’
বাউন্সি উইকেটে খেলতে অনভ্যস্ততা কাটানোর জন্য আগাম প্রস্তুতি না নেয়াতেই এই বিপর্যয়, বুলবুলের বিশ্লেষণ তেমনই। দলের সমস্যা পর্যবেক্ষণের পর তার উপলব্ধি, ‘এন্টিগা ও জ্যামাইকায় বল আসবে ১৪০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি গতিতে। আমাদের দেশে যে বল গুলোর গড়পড়তা হাইট থাকে পেট বা কোমড় সমান, ঠিক সেটাই ওয়েস্ট ইন্ডিজে লাফিয়ে বুক, কাঁধ বা মুখ সমান উঠবে এবং বাড়তি সুইংও করবে। প্রস্তুতির সময় সেই বাড়তি স্পিড, বাউন্স আর মুভমেন্টের কথা মাথায় ছিল না কিনা সন্দেহ। আমাদের ক্রিকেটাররা এক ধরনের উইকেটে ক্রমাগত খেলতে খেলতে হঠাৎ অনভ্যস্ত ও তুলনামূলক কঠিন কন্ডিশনে খেলতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্টে সেটাই কাল হয়েছে।’
এমএমআর/জেআইএম