করুণ ব্যাটিং প্রদর্শনীতে বিশাল পরাজয় টাইগারদের
তেল শেষ হয়ে বাতি নিভে যাওয়ার আগে যেমন হঠাৎ ধপ করে জ্বলে ওঠে, ঠিক তেমনি নুরুল হাসান সোহানও শেষ মুহূর্তে জ্বলে উঠেছিলেন। রুবেল হোসেনকে নিয়ে ৫৫ রানের দারুণ একটি জুটিও গড়েছিলেন সোহান। নিজে খেলেছিলেন ৭৪ বলে ৬৪ রানের ইনিংস। রুবেল খেলেন ১৬ রানের ইনিংস। সোহানের এই ধপ করে জ্বলে ওঠাতে শুধু হারের ব্যবধানই কমেছে; কিন্তু ইনিংস পরাজয় এড়ানো মোটেও সম্ভব হয়নি।
শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিগা টেস্টে বাংলাদেশ হেরেছে এক ইনিংস ও ২১৯ রানের বিশাল ব্যবধানে। প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ১৪৪ রানে। তাও সম্ভব হয়েছে সোহানের ৬৪ রান এবং রুবেলকে নিয়ে গড়া ৫৫ রানের জুটির কল্যাণে।
‘তেতাল্লিশ’ রানে অলআউট হওয়া মানেই ম্যাচ শেষ। পাঁচ দিনের খেলায় ওই অল্প ক’টা রান ও সোয়া ঘণ্টা সময়ে প্রথম ইনিংস শেষ হওয়া মানেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়া। এই বোধ-উপলব্ধি পাড়া-গলির অবুঝ কিশোরটিরও জানা। সুতরাং, অ্যান্টিগা টেস্ট নিয়ে আসলে কোন আশা ভরসা ছিল না বাংলাদেশ সমর্থকদের। তারওপর ক্যারিবীয়দের ৪০৬ রান করার পর ৩৬৩ রানে পিছিয়ে পড়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই ইনিংস পরাজয় অনিবার্য ছিল।
এটুকু শুনে মনে হতে পারে বাংলাদেশ কি কখনো দ্বিতীয় ইনিংস ৩৬৩ করেনি? তা করেছে, কিন্তু এই ম্যাচে ৪৩ রানে অলআউট হওয়ার ধাক্কা সামলে ৩৬৩ যে ৬৬৩’র শামিল। কাজেই বাংলাদেশ ইনিংসে হারতে যাচ্ছে এবং অতি নাটকীয় ঘটনা না ঘটলে খেলা তিনদিনেই শেষ তা ধরে ভেবেই আজ টিভির সামনে বসেছিলেন বাংলাদেশ সমর্থকরা।
যদিও বিশ্বকাপে ফ্রান্স এবং উরুগুয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের কারণে, অধিকাংশ দর্শকই টিভির চ্যানেল ঘোরাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবুও যারা বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখার জন্য টিভি চ্যানেল ঘোরাননি, তাদেরকেও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাধ্য করেছিলেন চ্যানেল ঘোরাতে। কারণ, দিনের দ্বিতীয় বলেই যে, উইকেটটা দিয়ে ফিরেছিলেন তিনি! এমন ব্যাটিং দেখার জন্য তো আর কেউ বিশ্বকাপে বারুদে ঠাসা কোয়ার্টার ফাইনাল মিস করতে পারেন না!
বাংলাদেশের পরাজয় মূলতঃ নিশ্চিত হয়েছিল দ্বিতীয় দিন শেষেই। আনুষ্ঠিকতা শেষ করতেই নামতে হয়ে তৃতীয় দিনে। নুরুল হাসান সোহানের দৃঢ়তায় বাড়তে থাকে ম্যাচের দৈর্ঘ্য। প্রথমে কামরুল ইসলাম রাব্বি ও পরে রুবেল হোসেনের সাথে সোহানের ক্ষণিকের প্রতিরোধে কেবল পেছানোই সম্ভব হয় স্বাগতিকদের জয়। শেষপর্যন্ত ইনিংস ও ২১৯ রানের ব্যবধানে জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে লিড নিয়েছে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ম্যাচের শুরুতে কেউ কেউ তিন উইকেটরক্ষক খেলানো নিয়ে কটুক্তি করেছেন; কিন্তু সেটা আর ধোপে টিকছে না। কারণ সোহান সাত নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে দলের পক্ষে ম্যাচের একমাত্র পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস হাঁকিয়েছেন। দলকে পার করিয়েছেন তিন অংকের রানের কোটা। একাই লড়াই করেছেন ক্যারিবীয় পেসারদের বিপক্ষে।
সাত ব্যাটসম্যান ফর্মুলায় কেন দুই কিপার মুশফিক-লিটনের সাথে নুরুল হাসান সোহান? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের প্রশ্নের তীর ছিল কিপার সোহানের দিকে। প্রথম দিন কামরুল ইসলাম রাব্বির বলে লোপ্পা ক্যাচ ফেলে সেসব সমালোচনাকারীদের নড়ে চড়ে বসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন সোহান। কিন্তু চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ের এই সময়ে খানিক সময় একপ্রান্ত আগলে রেখে ও দলের একমাত্র পঞ্চাশ হাঁকিয়ে সোহান জানান দিলেন তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবেও টেস্ট খেলার যোগ্য।
সোহান লড়াই করলেও অপর প্রান্তে ছিলেন না কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান। পুরোদস্তুর বোলার রুবেল বা রাব্বিকে নিয়ে আর কতদূরই যাওয়া যায়। সোহানও থেমেছেন ব্যক্তিগত ৬৪ রানে। সোহান থামার সাথেই নিশ্চিত হয় ক্যারিবীয়ানদের জয়। আউট হওয়ার আগে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশত করেন সোহান। রুবেলের সাথে নবম উইকেটে গড়েন পঞ্চাশ রানের জুটি।
ক্যারিবীয়দের পক্ষে প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয়া কেমার রোচ এই ইনিংসে বোলিংই করতে পারেননি। তবে এই ইনিংসে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মরণ ছোবল দিয়েছেন শ্যানন গ্যাব্রিয়েল। একাই নিয়েছেন ৫টি উইকেট। অধিনায়ক জেসন হোল্ডার নেন ৩টি উইকেট। অন্য দুই উইকেট নেন মিগুয়েল কামিন্স।
বাংলাদেশ আগেও ইনিংসে হেরেছে বহুবার। এর চেয়েও বড় ব্যবধানে হারের রেকর্ডও আছে; কিন্তু পরপর দুই ইনিংসে এতো কমে অলআউট হওয়ার রেকর্ড ছিল না কখনো। একইভাবে উভয় ইনিংসে আগে কখনো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এতো বিব্রত, বিপর্যস্ত ও আড়ষ্ট মনে হয়নি কখনো।
বোঝাই গেছে ঘরের মাঠে সারাবছর স্লো এবং লো ট্র্যাকে খেলা যেখানে মুভমেন্ট, সুইং কিংবা টার্নের বালাই থাকে না। গড়পড়তা ১৩০-১৩৫ কিমির উপরে উঠে হাতেগোনা। থ্রি-কোয়ার্টার কিংবা গুডলেন্থ থেকে হঠাৎ বুক সমান উচ্চতায় বল লাফিয়ে ওঠে না- মরা, নির্জীব ও শতভাগ ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে খেলার চড়া মাশুল এই করুণ ব্যাটিং বিপর্যয়।
সারা বছর ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি খেলায় অধিক মনোযোগী সাকিব-তামিমরা, ঘরের মাটিতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেন খুব কম। অধিনায়ক সাকিব লাল বলে খেলতে নেমেছেন নয় মাস বিরতি দিয়ে। যেখানে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের প্রায় সব তারকা ক্রিকেটার নিয়মিত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষ তারকাদের জাতীয় লীগ ও বিসিএল ইচ্ছে নেই বললেই চলে।
অ্যান্টিগা টেস্টের এই বিপর্যয় বা করূণ পরিণতিই বলে দিচ্ছে টেস্টে ভালো করতে হলে স্পোর্টিং উইকেটে আরো অনেক বেশি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলতে হবে। স্টিভ রোডস কেনো, ড্যারেন লেহম্যান, টম মুডি, স্টুয়ার্ট ল, গ্যারি কার্স্টেন, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারদের বেটে খাওয়ালেও লাভ হবে না। যদি না ঘরের মাঠে মরা পিচ বাদ দিয়ে সতেজ উইকেটে নিয়মিত দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ আয়োজন করা হয়।
এসএএস/আইএইচএস