হাথুরুসিংহের মতো স্টিভ রোডসের পথচলাও শুরু সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে
সেই ১৯৯০ সালে হল্যান্ডে আইসিসি ট্রফি খেলতে যাবার আগে সাবেক নামী পাকিস্তানি অলরাউন্ডার মুদাসসর নজর (ওপেনিং ব্যাটসম্যান কাম মিডিয়াম পেসার) দিয়ে শুরু। তারপর ভারতের প্রথম বিশ্বকাপের বিজয় নায়ক (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল আর ফাইনালে লয়েড, রিচার্ডস, গ্রিনিজ, হেইন্স, হোল্ডিং, রবার্টস, মার্শাল ও গার্নারের গড়া ভীষণ শক্তিশালি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যান অফ দ্যাচ ম্যাচ) মহিন্দর অমরনাথ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণ সময়ের এক নম্বর ওপেনার ও ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র গর্ডন গ্রিনিজ বাংলাদেশের তিন নম্বর কোচ হিসেবে আসেন ১৯৯৭ সালে। আর ৯৯‘র বিশ্বকাপেই শেষ হয় বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তার কর্মজীবন। ২০০০ সালে টেস্ট জগতে পা রাখার আগে ওই তিন নামী ক্রিকেটারই ছিলেন টিম বাংলাদেশের কোচ।
আর টেস্ট খেলা শুরুর অল্প সময় পর দক্ষিণ আফ্রিকার নামি ও বরেণ্য ক্রিকেট ব্যক্তি এডি বারলো চলে আসেন টিম বাংলাদেশের পরামর্শদাতা ও প্রধান উপদেষ্টা হয়ে। টেস্ট খেলা শুরু করা বাংলাদেশ দল চলে যায় এ প্রোটিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে। একটা নতুন টেস্ট খেলিয়ে দেশ ও দলের সম্ভাব্য গতিপথ কেমন হওয়া উচিত, তা চমৎকারভাবে বাতলে দিয়েছিলেন এডি বারলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ মেধাবী, দূরদর্শি এবং প্রখর ক্রিকেট জ্ঞান ও বোধ সম্পন্ন কোচ পুরো চুক্তির মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে পড়ে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
তারপর বিভিন্ন সময় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সব সময়ের দুই চির সবুজ নায়ক ইয়ান ও গ্রেগ চ্যাপেল ভ্রাতৃদ্বয়ের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল, পাকিস্তানের মহসিন কামাল, ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার প্রথম বিশ্বকাপ বিজয়ের অন্যতম রূপকার ডেভ হোয়াটমোর, শন উইলিয়ামস, ব্যাটিংয়ের সূক্ষ্ণ কলাকৌশল জানা জেমি সিডন্স এবং সময়ের অন্যতম কুশলী কোচ স্টুয়ার্ট ল, রিচার্ড পাইবাস, শেন জার্গেনসন-গত দেড়যুগে বেশ কজন নামী ও হাই প্রোফাইল কোচ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বাইরে ২০০২-২০০৩ সালে পাকিস্তানের মহসিন কামালও কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সর্বশেষ কোচ ছিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
এর মধ্যে মহসিন কামাল ছিলেন সবচেয়ে আনকোরা ও স্বল্প খ্যাতির। ক্রিকেট মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, বোধ, বুদ্ধি ও উপলব্ধিতে সবার পিছনে এই পাকিস্তানি। তার সময়ে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে সবচেয়ে খারাপ সময় কাটে বাংলাদেশের। আইসিসির দুই সহযোগি সদস্য কানাডা আর কেনিয়ার কাছেও হার মানে টাইগাররা।
খেলোয়াড়ি জীবন তথা ক্রিকেটার পরিচয়কে মূল মানদন্ড ধরলে মহসিন কামালের চেয়েও পিছনে হাথুরুসিংহে। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসের মত কালজয়ী বিশ্বমানের ফাস্টবোলার না হলেও ইমরান খানের সময় পাকিস্তান ক্রিকেটের চার পাঁচজন শীর্ষ পেসারের একজন ছিলেন মহসিন কামাল। সে তুলনায় ক্রিকেটার হাথুরুসিংহের নাম-ডাক ছিল আরও কম। মোদ্দা কথা, যে সব ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব বা সাবেক ক্রিকেটার বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্যে ক্রিকেটার্স প্রোফাইলকে বিবেচনায় আনলে সবার পিছনে হাথুরুসিংহে।
শ্রীলঙ্কার হয়ে ২৬টি টেস্ট ও ৩৫ ওয়ানডে খেলা হাথুরুসিংহে যখন বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসেন, তখন কোচ হিসেবে তার সে অর্থে তেমন পরিচিতিই ছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই অল্প পরিচিত আর কম নাম-ডাকের হাথুরুসিংহেই শেষ পর্যন্ত সফল কোচ হিসেবে সমাদৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার নাম এখন কম বেশি সবাই জানে।
সেদিক বিবেচনায় টাইগারদের নতুন কোচ স্টিভ রোডসের নাম-ডাক আরও কম। গত জুনে রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে তিন দিনের ছোট্ট অনুশীলন ক্যাম্প দিয়ে শুরু হয়েছে কোচ হিসেবে তার যাত্রা। তবে আজ থেকে অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট শুরু বাংলাদেশের নতুন কোচের। কেমন হবে তার পথচলা? তার অধীনে কি করতে পারে বাংলাদেশ? হাথুরুসিংহে যেখানে থেমেছেন, সেখান থেকে এগিয়ে নিতে পারবেন রোডস, নাকি তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন? সেটাই দেখার বিষয়।
তবে কঠিন সত্য হলো, দায়িত্ব শুরু করেই এক কঠিন মিশনে স্টিভ রোডস। বাংলাদেশ জাতীয় দল ঠিক ভালো অবস্থায় নেই। অবশ্য সেটা হাথুরুসিংহের শেষ সময় থেকেই নেই। এ লঙ্কানের সময় বেশ কিছু সাফল্য অর্জিত হলেও গত অক্টোবর-নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তার অধীনেই ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি; তিন ফরম্যাটেই হোয়াইটওয়াশ হয়েছে।
তারপর থেকে কোচশূন্য হয়ে ‘মাঝি বিহীননৌকায়’ পরিণত হওয়া। মাঝের সময়ে খালেদ মাহমুদ সুজন, রিচার্ড হালসাল আর কোর্টনি ওয়ালশকে দিয়ে ঠ্যাকা কাজ চালানোর চেষ্টা সফল হয়নি। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার কাছে টেস্ট এবং তিন জাতি ওয়ানডে টুর্নামেন্টে নাকাল। তারপর শ্রীলঙ্কায় তিন জাতি টি-টোয়েন্টি ট্রফি নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে গিয়ে অল্পের জন্য ট্রফি না জিততে পারার আক্ষেপে পোড়া। শেষ বলে গিয়ে শিরোপা হাতছাড়া। সে পারফরমেন্স আশার প্রদীপ জ্বাললেও আবার খাদের কিনারায় পড়ে যাওয়া। এই তো গত মাসে ভারতের দেরাদুনে আফগানিস্তানের সাথে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে সব ম্যাচ হার। ঠিক তার পর নতুন কোচ খুঁজে পাওয়া। ৫৪ বছরের ইংলিশ স্টিভ রোডসের কাঁধে টিম বাংলাদেশের দায়িত্ব দেয়া।
নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সময় প্রায় সব ফরম্যাটে পারফরমেন্সের গ্রাফ নিচে নেমে গেছে। এবং টাইগাররা নিজেদের খুঁজেও পাচ্ছেন না। এতে করে আত্মবিশ্বাসে চির ধরেছে। নিজেদের সামর্থর প্রতি আস্থাও কমেছে বেশ। সেগুলো জাগিয়ে তোলাই হবে নতুন কোচের প্রথম দায়িত্ব। নুয়ে পড়া আস্থা ফিরিয়ে আনাই শেষ কথা নয়। ক্রিকেটারদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা জন্মানোটাও খুব জরুরি। দলটি আসলে কেমন? তাদের শক্তি-সামর্থই বা কতটা? দেশে ও বাইরে কোথায় তারা কেমন খেলে? এ দলের ঠিক কোথায় কোন ঔষধ লাগবে? এসব আগে খুঁজে বের করতে হবে তাকে। এবং সবশেষে রোগ বুঝে ওষুধ দিতে হবে। দেখা যাক এ কাজগুলো কেমন করেন স্টিভ রোডস।
তবে নতুন কোচের জন্য একটা আশার খবর আছে। ইতিহাস জানাচ্ছে, চার বছর আগে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহের ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে।
২০১৪ সালের আগস্টে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে গিয়ে রীতিমত নাস্তনাবুদ হয়ে ফিরেছিল বাংলাদেশ। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি তিন সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল টিম বাংলাদেশ। সেই শুরুতে খারাপ খেলাটা হয়েছিল কোচ হাথুরুসিংহের জন্য ‘শাপে বর।’
দলের সত্যিকার দুর্বলতা কোথায়, কোন পরিবেশে ক্রিকেটারদের কার কি সামর্থ্য এবং দলের ঘাটতি ও শূন্যতার জায়গাগুলো কোথায়, তা নিজ চোখে দেখে খুব ভালোই বুঝে গিয়েছিলেন হাথুরু। সেটাই পরবর্তীতে তার কোচিং পদ্ধতি ও রণকৌশল সাজাতে পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে।
দেখা যাক, স্টিভ রোডসের অধীনে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেই এবার প্রথম সিরিজে কেমন খেলে টাইগাররা!
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম