কলম্বোয় মিরপুরের দুঃস্মৃতি ফিরিয়ে আবারও খলনায়ক রুবেল
এক বলে দরকার ৫। বাউন্ডারি হলে টাই। ছক্কা ছাড়া জেতার পথ নেই। এমন হিসেব সামনে রেখে বল করতে আসলেন বাংলাদেশের অনিয়মিত জেন্টল মিডিয়াম সৌম্য সরকার। তার করা ম্যাচের শেষ বলে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে তুলে মারলেন ভারতীয় কিপার কাম মিডল অর্ডার দিনেশ কার্তিক। সৌম্য পুরোদস্তুর পেসার নন। তাই অনেক ভেবে চিন্তে হয়ত ইয়র্কার লেন্থেই বল ফেলতে চেয়েছিলেন।
ওই সময় দিনেশ কার্তিকের মত অভিজ্ঞ ও পরিণত ব্যাটসম্যানের কাছে লেন্থ ডেলিভারি মানেই বিগ হিট নেয়ার আদর্শ বল। দিনেশ কার্তিক সামনের পায়ের ওপর ভর করে হাঁকালেন। বল খুব বেশি উচ্চতায় না উঠে বাতাসে ভেসে সোজা এক্সট্রা কভার আর লং অফের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে আছড়ে পড়লো সীমানার ওপারে। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্ল্যাট সিক্স’- ঠিক তাই হলো।
আর তাতেই খেলার শেষ বলে ৪ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয়ের স্বদ পেলো ভারত। এরই সাথে ট্রফি জয়ের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হলো বাংলাদেশের। ১৬৬ রানের পুঁজি নিয়েও সাকিব বাহিনী লড়েছে প্রাণপন। এক সময় মনে হচ্ছিলো জিতেই যাচ্ছে টাইগাররা। ১২ বলে ভারতের দরকার পড়ে ৩৪ রানের। সেই সময় একটি ভাল ওভার হলেই হয়ত প্রথম ট্রফি জয়ের মধুর স্বাদ মিলতো। প্রেমাদাসায় ট্রফি উঁচিয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠতে পারতেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ আর সাব্বিররা।
কিন্তু হায়! এমন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে সর্বনাশ ডেকে আনলেন পেসার রুবেল হোসেন। শুনতে খারাপ লাগবে। তবে কঠিন সত্য হলো, আবার ফাইনালে খলনায়ক হয়ে থাকলেন রুবেল হোসেন। কলম্বোর প্রেমাদাসায় ফিরে এলো শেরে বাংলার মাতম। ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রায় একই পরিস্থিতিতে রুবেলের শেষ দুই ওভারে দেয়া ৩৩ রানে নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়েছিল।
কাকতালীয়ভাবে সেটাও ছিল তিন জাতি টুর্নামেন্ট। তবে পার্থক্য একটাই; ৯ বছর আগের ম্যাচটি ছিল ৫০ ওভারের ম্যাচে আসর। আর এটা টি-টোয়েন্টি আসরের ফাইনাল। লঙ্কানদের সাথে ফাইনালে বাংলাদেশের পুঁজি ছিল মাত্র ১৫২ রান।
কিন্তু ওই সামান্য কটা রান নিয়েও প্রাণপন লড়াই করে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে বাংলাদেশ। বোলিং সহায়ক উইকেটে লঙ্কান গ্রেট কুমারা সাঙ্গাকারা ছাড়া সে অর্থে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কোন ব্যাটসম্যানই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। শুরুতে লঙ্কান ব্যাটিংয়ের ওপর প্রবল আক্রমণ টাইগারদের। এক পর্যায়ে মাত্র ৬ রানে ইনিংসের অর্ধেকটা খুইয়ে বসে লঙ্কানরা।
আউট হয়েছিলেন লঙ্কান পাঁচ প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান উপুল থারাঙ্গা (২), সনাথ জয়সুরিয়া (০), মাহেলা জয়বর্ধনে (০), কাপুগেদারা (১), থিলান থুসারা (১)। প্রথম ছয় স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের মধ্যে একমাত্র রান করেন কুমারা সাঙ্গাকারা (১৩৩ বলে ছয় বাউন্ডারিতে ৫৯)। ৬ রানে ৫ উইকেট হারানো শ্রীলঙ্কা সাঙ্গাকারার হাত ধরে খানিক বিপর্যয় কাটায়। তারপরও ৫১ রানে পতন ঘটে ৬ উইকেটের।
কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি টাইগারদের। শেষ দিকে ব্যাটসম্যান জিহান মোবারক ১৬, দুই বোলার পারভেজ মাহারুফ (৭৬ বলে ৩৮*) আর মুত্তিয়া মুরালিধরনই (১৬ বলে চার বাউন্ডারি আর দুই ছক্কায় ৩৩) বদলে দেন খেলার চালচিত্র। হাতে ২ উইকেট থাকা অবস্থায় শেষ ৩০ বলে ৩৫ রান দরকার ছিল শ্রীলঙ্কার।
মনে হচ্ছিল জিততে যাচ্ছে বাংলাদেশ; কিন্তু ৪৬ নম্বর ওভারে পেসার রুবেল হোসেন ২০ রান দিয়ে বসলে জয়ের পথ থেকে ছিটকে পড়ে টাইগাররা। তার ওই ওভারের সবকটা বলে রান তুলে নেন লঙ্কান অফ স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন। এরপর সাকিব ৪৭ নম্বর ওভারে টাইট বোলিং করে মাত্র ২ রান দিলে মৃদু সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে; কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮ বলে ১৩ রান দরকার থাকা অবস্থায় আবার রুবেল ১২ রান দিয়ে বসেন। তার ওই ওভারের প্রথম চার বলে আসে দুই রান (০+১+ ০+ ১+) । তারপর আবার মুরালিধরন ঝড়। শেষ দুই বলে প্রথমে বাউন্ডারি। পরে ছক্কা। তাতেই জয়ের প্রদীপ দপ করে নিভে যায়। বাংলাদেশ হারে ২ উইকেটে ১১ বল আগে।
ঠিক আজকের ম্যাচেও প্রায় একই অবস্থা। ১২ বলে ৩৪ রান দরকার ছিল ভারতীয়দের। ১৯ নম্বর ওভারে বল করতে এসে রুবেল ২২ রান দিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনেন। তার ওই ওভারে দুই ছক্কা, দুই বাউন্ডারি ও একটি ডাবলসহ ২২ তুলে নেন ভারতের জয়ের নায়ক দিনেশ কার্তিক। ওই ওভারে রুবেল ২২ রান দিয়ে ফেলায় ভারতের সমীকরন অনেক সহজ হয়ে যায়।
এদিকে অধিনায়ক সাকিব, কাটার মাস্টার মোস্তাফিজের বোলিং কোটা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। দুই প্রান্তে ডান হাতি ব্যাটসম্যান ক্রিজে। তা দেখে মিরাজ কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বোলিংয়ে না এনে শেষ দিকে সৌম্যকে দিয়ে বোলিং করালেন সাকিব। আর তার প্রথম পাঁচ বলে সাত রান উঠলেও দিনেশ কার্তিক শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে প্রথম ট্রফি জয়ের উৎসব মাটি করে টাইগারদের বেদনায় নীল করে দিলেন।
কোন টুর্নামেন্টের ট্রফি জেতা হলো না আবারো। ট্রফি সোনার হরিণ হয়েই থাকলো।
এআরবি/আইএইচএস/জেএইচ