প্রেমাদাসায় ট্রফি হাতে আজ বিজয় উল্লাস সাকিবদের?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুজপ্রতিম শুভানুধ্যায়ী-সুহৃদ শিমুলের কৌতুহলি প্রশ্ন- ‘আচ্ছা, ভাইয়া টিম বাংলাদেশকে কখনো কোন আসর বা টুর্নামেন্টে শেষ হাসি হাসতে দেখেছেন? টাইগাররা কি কোনদিন ট্রফি হাতে বিজয় উল্লাস করতে পেরেছে? লাল সবুজ জার্সি গায়ে টাইগারদের কোন টুর্নামেন্ট জিতে ‘ভিক্টরি ল্যাপ’ দেয়ার দৃশ্য দেখেছেন কোনদিন?’
হ্যাঁ দেখেছি। অবশ্যই দেখেছি। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফি হাতে আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাসুদ পাইলট, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক, সাইফুল ইসলামদের বিজয় উল্লাস নিজ চোখে দেখেছি।
আইসিসি ট্রফি জেতার পরদিন কুয়ালালমপুর থেকে রাজধানী ঢাকা ফিরে বীরোচিত সংবর্ধনায় সিক্ত হয়েছিল টিম বাংলাদেশ। বাংলা নববর্ষের শুভ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আকরাম বাহিনীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ ভবনের বাইরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জনাকীর্ন সে ফুলেল সংবর্ধনায় আকরাম খানের ট্রফি উঁচিয়ে তোলা ছবি অনেকদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতীক হয়েছিল।’
সেটা তো আইসিসি ট্রফি। যাতে প্রতিদ্ব›দ্বী সব দলই ছিল আইসিসির সহযোগি সদস্য দেশ। ফাইনালে কেনিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ; কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশ কি কখনো তিন বা চার জাতি কিংবা কোন মহাদেশীয় বা বিশ্ব আসরে ট্রফি জিততে পেরেছে?
অনুজ শিমুল একা নয়। অনেকেরই কৌতুহলি প্রশ্ন, টেস্ট খেলুড়ে দেশ বাংলাদেশ কী সত্যিই কখনো কো আন্তর্জাতিক আসরে ট্রফি জেতেনি? উত্তর একটাই- নাহ, কখনো জেতেনি। শেষ অবধি ট্রফি হাতে বিজয় উল্লাস করতে না পারলেও ট্রফি জেতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কয়েকবার।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হওয়া ২০১৬ সালের এশিয়া কাপ ছাড়া আরও তিন তিন তিনটি আসরে ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েও ট্রফি জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তাই কোনো আন্তর্জাতিক আসরের শিরোপা ও ট্রফি হাতে বিজয় উল্লাস করা হয়নি কখনো। টাইগারদের কাছে ট্রফি তাই ‘সোনার হরিণ।’
আজ কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে সেই সোনার হরিণের দেখা মিলবে? মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহীম আর মাশরাফি বিন মর্তুজার বাংলাদেশ যা পারেনি, সাকিবের নেতৃত্বে সেই ট্রফি বিজয়ের দূর্লভ কৃতিত্ব অর্জিত হবে?
রোববার রাতে ট্রফি হাতে শেষ হাসি হাসতে পারবেন সাকিব? ইতিহাস জানাচ্ছে বাংলাদেশ প্রথম তিন জাতি আসরের ফাইনাল খেলে ২০০৯ সালে। ফাইনালে টাইগারদের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। রাউন্ড রবিন লিগ পর্যায়ে শ্রীলঙ্কাকে হারালেও ফাইনালে গিয়ে আর পারেনি বাংলাদেশ।
এরপর ২০১২ সালে ৫০ ওভারে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানের পরাজয় সঙ্গী হয়। চার বছর পর ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এশিয়া কাপের ঝড়- বৃষ্টি বিঘিœত ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৮ উইকেটের পরাজয় আক্ষেপকে আরও প্রবল কওে তুলেছে।
এর মধ্যে দুটি ফাইনালের কথা কখনো বাংলাদেশের ভক্তরা ভুলবেন না কোনদিন। দুটি ম্যাচই হয়েছিল শেরে বাংলায়। যার প্রথমটি এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি। বোলিং সহায়ক উইকেটে লঙ্কান গ্রেট কুমারা সাঙ্গাকারা ছাড়া সে অর্থে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কোনো ব্যাটসম্যানই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি।
১৫২ রানের মামুলি পুঁজি নিয়েও সেদিন প্রাণপন লড়াই চালিয়েছিল টাইগাররা। বাংলাদেশের বোলিং তোপের মুখে শুরুতে ৬ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে লঙ্কানরা। প্রথম ছয় স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের মধ্যে একমাত্র কুমারা সাঙ্গাকারা (১৩৩ বলে ছয় বাউন্ডারিতে ৫৯) মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। চরম বিপাকে পড়া শ্রীলঙ্কা সাঙ্গাকারার হাত ধরে খানিক বিপর্যয় কাটায়। তারপরও ৫১ রানে পতন ঘটে ৬ উইকেটের। টাইগাররা তখন অল্প পুঁজি নিয়েও জয়ের স্বপ্নে বিভোর।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। লঙ্কান দলের লোয়ার অর্ডারের জিহান মোবারক ১৬ আর দুই বোলার পারভেজ মাহারুফ (৭৬ বলে ৩৮*) ও বিশ্ব সেরা অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনই (১৬ বলে চার বাউন্ডারি আর দুই ছক্কায় ৩৩) বদলে দেন খেলার চিত্র।
২ উইকেট অক্ষত থাকা অবস্থায় ৫ ওভারে ৩৫ রান দরকার হলেও পারভেজ মাহারুফ ও মুরালিধরনরা তা তুলে নেন। ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে আবারো স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় নীল হয় বাংলাদেশ। ২০১২ সালের ২২ মার্চ ফাইনালে পাকিস্তানীদের ২৩৬ রানে বেঁধে ট্রফি জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল মুশফিক বাহিনী; কিন্তু শেষ ওভারে গিয়ে হতাশায় ডুবতে হয় আবারও। ৩ উইকেট হাতে রেখে ৬ বলে ৯ রান করতে না পেরে হেরে যায় মুশফিকের দল।
এরপর ২০১৬ সালের ৬ মার্চ শেরে বাংলায় আবার ফাইনালে স্বপ্ন ভঙ্গের ম্যাচ হয়ে থাকলো। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচটি প্রবল ঝড়ো বাতাস ও ভারী বর্ষণে ২০ ওভার থেকে কমে ১৫ ওভারে গড়ায়। তাতে ১২০ রানের মামুলি স্কোর নিয়ে ৮ উইকেটে হার মানে মাশরাফির দল।
সবশেষে মাত্র ৫১ দিন আগে (২৭ জানুয়ারি) আবারো ফাইনালে বিপর্যয়। দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৯ রানে হেরে যাওয়া। সারা বছর যে মাঠে অনুশীলনে কাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেখানে ক্লাব ক্রিকেট, জাতীয় লিগ, বিসিএল আর বিপিএল খেলে খেলে এতদুর এসেছেন সবাই, সেই শেরে বাংলায় লঙ্কানদের ২২১ রানে বেঁধে ফেলেও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি মাশরাফি বাহিনী। মাত্র ১৪২ রানে অলআউট হয়ে যায় তারা।
অথচ একই আসরে দুই পর্বের রাউন্ড রবিন লিগের প্রথম সাক্ষাতে লঙ্কানদের বিপক্ষে ১৬৩ রানের রেকর্ড জয় দিয়েছিল ধরা। প্রথম ম্যাচে ৩২০ রান করা দল, ফাইনালে ২২২ রানের টার্গেট ছুঁতে গিয়ে নাজেহাল। ভাবা যায়!
বারবার ফাইনালে হার এবং বিপর্যয় জন্ম দিয়েছে এক বড় প্রশ্নের। তবে কি ‘ফাইনাল আর ট্রফি’ই বড় চাপ টাইগারদের? ফাইনালে গিয়ে কি নিজেদের হারিয়ে ফেলেন তারা? ট্রফি জেতার চাপে কি আত্মবিশ্বাস, সামর্থ্যরে প্রতি আস্থা যায় কমে?
বার বার ফাইনালে হেরে যাওয়ায় সে প্রশ্নই উঁকি-ঝুঁকি দেয় সবার মনে? দেখা যাক, এবার সে ট্রফি খরা কাটে কি না! রাউন্ড রবিন লিগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই জয়ে দল অবশ্যই চাঙ্গা। মুশফিকুর রহীম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ম্যাচ জেতানো পারফরমেন্স আত্মবিশ্বাস আর আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই।
তার চেয়ে বড় কথা, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাফল্যের জন্য করণীয় কাজ কি কি? অনেক দিন পর তাও হয়েছে শেখা। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে ব্যাটিং সাফল্যের অলিখিত ফর্মুলাটা এবার নিদাহাস ট্রফির দুই ম্যাচে অনুসরণ করে দেখিয়েছে টাইগাররা।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম বার দুই ওপেনার তামিম-লিটন আর মিডল অর্ডারে মুশফিক, দ্বিতীয়বার ওপেনার তামিম আর মিডল অর্ডার মাহমুদউল্লাহ ঠিক কাজের কাজ করে দেখিয়েছেন। বোলাররা সে অর্থে এখনো ম্যাচ জেতাতে পারেননি। তবে আগের ম্যাচে ৪১ রানে লঙ্কান ইনিংসের অর্ধেকটার পতন ঘটিয়ে সাফল্যের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন সাকিব, মোস্তাফিজ, মিরাজ ও রুবেলরা।
পরে কুশল পেরেরা আর থিসারা পেরেরা শক্ত হাতে বিপর্যয় কাটানোর চেষ্টা করলেও ১৫৯‘তে গিয়ে থামেন। তামিমের ফিফটি আর মাহমুদউল্লাহর ১৮ বলে ৪৩ রানের হার না মানা ইনিংসে ঠিক জয়ের দেখা মিলেছে।
মুশফিক ফর্মের চুড়ায়। তামিম-মাহমুদউল্লাহও টগবগ করে ফুটছেন। এখন লিটন, সৌম্য আর সাব্বির এবং অধিনায়ক সাকিবের কেউ একজন জ্বলে উঠলে কথা নেই। সাথে বোলারদের কার্যকর অবদানও খুব জরুরি। আগের ম্যাচে অর্ধেক সফল বোলাররা আজ ফাইনালে শতভাগ করণীয় কাজ করে দিলে অধরা ট্রফি ধরা দিতেও পারে।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর