‘ফেবারিট’ ভারতকে হারানোর সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ভারতের বিপক্ষে এখনও পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে জেতেনি বাংলাদেশ। নিদাহাস ট্রফিতেও যে দু’বার দেখা হয়েছে, প্রতিবারই হেরেছে টাইগারর। আগে কখনো জয়ের রেকর্ড নেই, এ আসরেও পরাজয়ই সঙ্গী হয়ে আছে।
তাই কালকের ফাইনালে কাগজে-কলমে ফেবারিট ভারতই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে শেষ ওভারের রুদ্ধশ্বাস জয়ের পরও রোববারের ফাইনালে বাংলাদেশ ‘আন্ডারডগ’।
বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞ আর বিশ্লেষক- সবাই এমন হিসাব-নিকাশই করছেন। তবে কি বাংলাদেশের জেতার কোনই সম্ভাবনা নেই? এবারও ট্রফি ‘সোনার হরিণ’ হয়ে থাকবে? সাফল্যের এবারও ধরা দেবে না?
ভক্ত-সমর্থকরা সাফল্যের জন্য উন্মুখ; কিন্তু মনে রাজ্যের দ্বিধা, সংশয়। সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহরা ফাইনালে গিয়ে পারবেন তো? নাকি আগের সেই না পারার বৃত্তেই আটকে থাকবে? মোট কথা, আস্থাটা কম।
সেটা ভারত না হয়ে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা হলে হয়ত এতক্ষণে উৎসবের মঞ্চ সাজিয়ে বসতেন কেউ কেউ; কিন্তু ভারত বলেই মনে যত দ্বীধা। আইপিএল খেলে খেলে হাত পাকিয়ে বসার কারণেই হোক, কিংবা প্রচুর বিকল্প এবং কার্যকর পারফরমার থাকার কারণেই হোক- টি-টোয়েন্টিতে ভারতীয়রা সত্যিই এখন অনেক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী। প্রতিপক্ষ হিসেবে খুব কঠিন।
নিয়মিত অধিনায়ক ও রান মেশিন বিরাট কোহলি আর অনেক সাফল্যের মিশনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি নেই। সময়ের অন্যতম সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া ও পেসার জসপ্রিত বুমরাহও নিদাহাস ট্রফি খেলছেন না। তারপরও রোহিত শর্মার নেতৃত্বে যে দলটি খেলছে, সেটাও অনেক শক্তিশালী।
বেশ ক’জন উঁচু মানের ক্রিকেটারের সমারোহ আছে। রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান- বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা উদ্বোধনী জুটি। যারা সব ফরম্যাটেই ভারতের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ। সাথে মনিস পান্ডে ও লোকেশ রাহুল- যাদেরকে আগামী দিনে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের নির্ভরতার প্রতীক ভাবা হয়। এদের সাথে দুই স্পিনার ইউযবেন্দ্র চাহাল আর ওয়াশিংটন সুন্দর। যারা শতভাগ ব্যাটিং সহায়ক পিচেও বল ঘোরাতে পারেন। ব্যাটসম্যানদের স্বচ্ছন্দ-সাবলীল ও উত্তাল উইলোবাজির পথে বাঁধা হয়েও দাঁড়ানোর সামর্থ্য রাখেন।
মোট কথা, ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই ভারতীয় শিবির বেশ সমৃদ্ধ ও ম্যাচ জেতানো পারফরমারে ভরা। আর সবচেয়ে বড় কথা, দলটিতে কয়েকজন পরিণত ক্রিকেটার আছেন। যারা খুব ভাল জানেন, কোন উইকেটে, কার বিপক্ষে কখন কি করতে হবে?
শ্রীলঙ্কার সাথে এই দলটির মূল পার্থক্যের জায়গায়ই এটা। কুশল মেন্ডিস, কুশল পেরেরা, দানুসকা গুনাথিলাকা আর থিসারা পেরেরা- সবাই ফ্রি স্ট্রোক মেকার। শটস খেলতে পারেন বেশ। রোহিত, শিখর ধাওয়ান, মনিস পান্ডে আর লোকেশ রাহুলরা চার ও ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে ঝড়ের বেগে রান তোলার কাজে যেমন দক্ষ, ঠিক তেমনি চাপের মুখে ধরে খেলা, ধীরে ধীরে ইনিংসকে নতুন করে সাজানো এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে আবার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে রান গতি বাড়ানোর ক্ষমতাও রাখেন।
সেখানেই ভারতীয়রা এগিয়ে। চাপের মুখে লঙ্কান ব্যাটিং ভেঙ্গে পড়লেও ভারতীয়দের টলানো বেশ কঠিন। তাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি মাথায় রেখে খেলার সামর্থ্য ও ক্ষমতা বেশি। একইভাবে নুয়ান প্রদীপ, আকিলা ধনঞ্জয়া, দানুসকা গুনাথিলাকা আর থিসারা পেরেরারা একবার প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের মারের তোড়ে খেই হারিয়ে ফেললে আর সেভাবে কামব্যাক করতে পারেন না।
কিন্তু শারদুল ঠাকুর, ইয়ুযবেন্দ্র চাহাল আর ওয়াশিংটন সুন্দররা ঠিকই কামব্যাক করতে পারেন। পারেন বলেই ১২ মার্চ রাউন্ড রবিন লিগে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা মাত্র তিন উইকেট খুইয়ে ১১ ওভারে শতরান পার করে ফেলেও (১০.৪ ওভারে ৯৬ রানে তৃতীয় উইকেট পতন) ভারতীয়দের প্রতিরোধের মুখে দেড়শো’র আশপাশে থেমে যায়।
মিডিয়াম পেসার শারদুল ঠাকুর (৪ ওভারে ৪/২৭) আর অফ স্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দরের (২/২১) বোলিং তোড়ে হাতে সাত উইকেট থাকার পরও শেষ ১০ ওভারে ৫৬ রানের বেশি করতে পারেনি লঙ্কানরা।
একইভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষেও ১৭৬ রানকে শেষ পর্যন্ত জয়ের জন্য যথেষ্ঠ বলে প্রমাণ করেন ভারতীয় বোলাররা। অথচ এক সময় মনে হচ্ছিল টাইগাররা জিতে যাবে; কিন্তু অফ স্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দর প্রথম স্পেলে তামিম, লিটন দাস ও সৌম্যকে আউট করে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেন।
এরপর মুশফিক এক প্রান্তে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপন সংগ্রাম করেন; কিন্তু লেগস্পিনার চাহাল চার ওভারে (১/২১) একদম রানের গতি নিয়ন্ত্রনে রাখার পাশাপাশি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের জয়ের পথ রুদ্ধ করে দেন। মোট কথা, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং বেশ ধারালো। বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং কার্যকর।
কিন্তু তারপরও কালকের ফাইনালে আপনি টাইগারদের পক্ষে বাজি ধরতে পারেন। আগে কখনো জয় ধরা দেয়নি, তাতে কি! রোববার নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে বাংলাদেশ জিতে যেতে পারে। ভাবছেন, আবেগ থেকে বুঝি এমনটা বলা। আসলে তা নয়।
এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পারফরমেন্সে আছে সে জয়ের পূর্বাভাষ। প্রশ্ন উঠতে পারে, কি এমন আহামরি ও অস্বাভাবিক ভাল খেললো? কই ভারতকে তো একবারও হারাতে পারেনি। দুবারই হেরেছে। দুদিন মুশফিকুর রহীম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ জ্বলে উঠেছেন, আর ওই দুই ম্যাচেই লঙ্কানদের হারানো গেছে; কিন্তু আহামরি টিম পারফরমেন্স কি হয়েছে?
হ্যাঁ, তা হয়ত হয়নি; কিন্তু হবার উপক্রম ঘটেছে। ভারতের বিপক্ষে জিততে না পারলেও গত ১২ মার্চ প্রেমাদাসায় জয়ের জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ওই ম্যাচে ভারতকে ১৭৬ রানে আটকে রাখেন বোলাররা।
প্রেমাদাসার যে উইকেটে খেলা হচ্ছে, তাতে ওই রান টপকে যাওয়া অসম্ভব নয়, তার প্রমাণ বাংলাদেশের ২১৪ টপকে যাওয়া, প্রথম দিন ভারতের করা ১৭৪ রান টপকে লঙ্কানদের জয় আর কাল স্বাগতিকদের ১৫৯ রানের পিছু ধেয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ই বলে দিচ্ছে ১৬০-১৭০ রানের টার্গেট ছোঁয়া সম্ভব।
প্রথম দিন পুঁজি ছিল কম (মাত্র ১৩৯), তাই বোলাররা কিছু করে দেখানোর সুযোগ পাননি। পরের ম্যাচে উইকেট বেশি নিতে না পারলে ভারতের ব্যাটিংকে ১৭০ এর ঘরে বেধে রেখেছেন রুবেল ও নাজমুল অপুরা।
ওই রানের পিছু ধেয়ে মাত্র ৪০ রানে তিন উইকেট খুইয়েও মুশফিকের একার দৃঢ়তায় জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিল টাইগাররা। কাল শেষ দিকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ১৮ বলে যে ৪৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে দল জিতিয়েছেন, এত উত্তাল দরকার ছিল না, ভারতের বিপক্ষে ১৪ মার্চ মাহমুদউল্লাহ আর সাব্বিরের কেউ একজন ২০/২৫ বলে ১৫০ প্লাস স্ট্রাইক রেটে একটি ইনিংস খেলে দিলেই কাজ হয়ে যেত।
অর্থাৎ বোলাররা প্রমাণ দিয়েছেন আমরা রোহিত বাহিনীকে ১৭০‘র ঘরে আটকে রাখতে পারি। আর মুশফিকের একার দৃঢ়তায় ১৫৯ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়েছে। মোট কথা, ঠিক আগের ম্যাচে ভারতকে ১৭৬ রানে আটকে রেখে বোলাররা প্রমাণ দিয়েছে ভারতকে ১৭০-এর ঘরে আটকে রাখা সম্ভব।
তার মানে আগে ব্যাট করে ১৮০ প্লাস রান করতে পারলে বোলাররা তা ডিফেন্ড করতে পারবেন- এ আস্থা রাখা যায়। একইভাবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই জয়ের ম্যাচেই প্রমাণ হয়েছে প্রথম দুই-তিন জনের যে একজনার লম্বা ইনিংস আর চার, পাঁচ ও ছয় থেকে যে কেউ ঝড়ো ইনিংস খেলে ম্যাচ শেষ করে আসতে পারলে ১৭০ প্লাস টার্গেট ছোঁয়া সম্ভব।
শেষ কথা, ব্যাটিংয়ের সাথে বোলিংটাও হতে হবে ভাল। তবেই ভারতকে হারানো সম্ভব।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি