অঘোষিত সেমির যুদ্ধ : শ্রীলঙ্কার সামনে টাইগাররা
নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি নেই। সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও আসেননি। এক নম্বর পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া এবং পেসার জাসপ্রিত বুমরাহও নেই দলে। শক্তির অনুপাতে স্বাভাবিকের এক তৃতীয়াংশ কম নিয়েই নিদাহাস ট্রফি খেলতে এসেছে ভারত।
তাতে কি? চার খেলার তিনটিতে জিতে সবার আগে সেই ভারতই ফাইনালে। এখন আরেক ফাইনালিস্ট নির্ধারণ বাকি। ১৮ মার্চ কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে রোহিত শর্মার ভারতীয় একাদশের প্রতিপক্ষ হবে কে- বাংলাদেশ, না শ্রীলঙ্কা? তা নিয়েই রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন।
কোন জটিল অংক নেই। একদম সরল সমীকরণ। টাইগারদের সাথে লঙ্কানদের রবিন লিগের ফিরতি তথা শেষ ম্যাচটি এখন পরিণত হয়েছে অঘোষিত সেমিফাইনালে। কারণ বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা দুই দলের পয়েন্ট সমান সমান (তিন খেলায় এক জয়ের সুবাদে দুই করে)। কাল শুক্রবার ওই অনানুষ্ঠানিক সেমির যুদ্ধে যে জিতবে, সেই দলের পয়েন্ট দাঁড়াবে চার খেলায় চার। আর সমান ম্যাচে পরাজিত দলের পয়েন্ট দুই'ই থাকবে। খুব স্বাভাবিকভাবে বিজয়ী দল ভারতীয়দের সাথে ফাইনাল খেলবে।
মাত্র অল্প কিছু দিন আগে বাংলাদেশের মাটিতে টাইগারদের ওয়ানডে, টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি‘তে রীতিমত নাকাল করে ছেড়েছে লঙ্কানরা। তাদের শৌর্য্য-বীর্য্যর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি টাইগাররা। সে কারণেই নিদাহাস ট্রফি শুরুর আগে লঙ্কানদেরই ফেবারিট ভাবা হচ্ছিলো।
কিন্তু ১০ মার্চ মুশফিকুর রহীদের অবিশ্বাস্য উইলোবাজি, লিটন-তামিমের সাহসী ব্যাটিংয়ে পাওয়া অবিস্মরণীয় জয়ে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। ওই দিন স্বাগতিকদের করা ২১৪ রানের হিমালয় সমান স্কোর তাড়া করে জিতে রাতারাতি সব দৃশ্যপট পাল্টে দেয় টাইগাররা।
গতকাল ভারতের সাথে ফিরতি পর্বের ম্যাচেও জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল রিয়াদের দল। অধিনায়ক কোহলি, অভিজ্ঞ ধোনি, অলরাউন্ডার পান্ডিয়া আর পেসার বুমরাহ না থাকলেও রোহিত শর্মা, শেখর ধাওয়ান, মনিশ পান্ডে আর দিনেশ কার্তিকের মত ব্যাটসম্যান, চাহাল আর ওয়াশিংটন সুন্দরদের মত মেধাবী ও প্রতিভাবান স্পিনারদের নিয়ে সাজানো ভারতের দলটিও কিন্তু হেলা ফেলার নয়।
বরং বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় ভারতীয় শিবিরে কুশলী ক্রিকেটারের সংখ্যা বেশি। আইপিএল খেলে খেলে সবাই পরিণত। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী পারফরম করা এবং প্রতিপক্ষর শক্তি- সামর্থ্য আর উইকেটের চরিত্র বুঝে অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনটাও ভারতীয়রা ভালো জানে।
এমন এক পরিণত দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে জিততে আসলে কি কি করণীয়? তা কিন্তু ঠিক ঠাউরে উঠেছিল রিয়াদ বাহিনী। ভারতকে ১৬০ থেকে ১৭০ ‘র ঘরে বেঁধে ফেলতে পারলে জেতা সম্ভব- এই চিন্তায় টস জিতে বোলিংয়ে নামা।
সে লক্ষ্য পূরণ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। শেষ দিকে ভারতীয়রা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হাত খুলে রান গতি বাড়ালেও ১৭৬ ‘এ গিয়ে থেমে যায়। অর্থাৎ বোলাররা মোটামুটি তাদের কাজ করে দেখিয়েছেন। ব্যাটিংয়ে আগের ম্যাচে ওপরের দিকে লিটন আর তামিম পাওয়ার প্লে‘তে ৫.৫ ওভারে ৭৪ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা পথ।
আর সেই পথে হেঁটে মুশফিক ম্যাচ শেষ করে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরত আসেন। কাল সেই কাজটিই হয়নি। মুশফিক তার ভূমিকা ঠিকই পালন করেছেন। কিন্তু তামিম, লিটন আর সৌম্যর কেউ শুরুতে রান গতিও বাড়াতে পারেননি। উইকেট অক্ষত রাখার কাজটিও করতে পারেননি। শুরুর ১০ ওভারে রানও ওঠেনি তেমন। উইকেটও পড়েছে বেশি। আর তাতেই সম্ভাব্য জয় হয়েছে হাতছাড়া।
তারপরও বলা, ১৭ রানে হারলেও মুশফিকুর রহিম আবারো দ্যুতি ছড়িয়েছেন। পেসার রুবেল হোসেন ও বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপু বুদ্ধি খাটিয়ে ভালো জায়গায় বল করে ভারতীয়দের উত্তাল ব্যাটিং থেকে বিরত রেখেছেন। তাদের মাপা বোলিংয়ে ১৭৬ রানে থামে রোহিত শর্মার দল।
বোলাররা শেষ পাঁচ ওভারে গিয়ে খেই হারিয়ে না ফেললে এই রানও হতো না ভারতের। পাওয়ার প্লে‘র ৬, প্রথম ১০ ওভার ( ১/৭১) ও ১৫ ওভার (১/১১৭) পর্যন্ত ভারতীয়দের হাত খুলে খেলতেই দেননি রুবেল, অাবু হায়দার রনি ও নাজমুল অপু। কিন্তু শেষ ৫ ওভারে ৫৯ রান তুলেই ১৭০‘র ঘরে পৌঁছে যায় ভারত।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পাওয়ার প্লে‘ আর ১০ ওভার পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও শেষ সময়ে গিয়ে আর পারেনি। ভারতীয়রা শেষ ৩০ বলে প্রায় দ্বিগুণ (৫৯ রান) করলেও টাইগাররা তুলে ৪৩। ওই যে ১৬ রানের ঘাটতি সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ হারে ১৭ রানে।
আগের ম্যাচে ৩৫ বলে ৭২ রানের (স্ট্রাইকরেট ২০৫.৭১) হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরা মুশফিকুর রহিম এদিন অত আক্রমণাত্তক ব্যাটিং করতে না পারলেও এক প্রান্তে ঠিক সাহসী নাবিকের ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু আর কেউ সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতে না পারায় জয় ধরা দেয়নি। ওপরের দিকে তামিম,লিটন, সৌম্য আর মাঝখানে ও নিচের দিকে মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির ও মিরাজের একজন ১২০ থেকে ১২৫ স্ট্রাইকরেটে ৪০ রানের একটি ইনিংস খেলতে পারলেই হয়তো হয়ে যেত।
কিন্তু তারা কেউ তা পারেননি। তামিম ঝড়ের গতিতে শুরু করেও নিভে গেছেন দপ করে। ছয় নম্বরে নামা সাব্বিরের সামনে সুযোগ ছিল। কিন্তু সময়ের চাহিদা পূরন করার মত বুদ্ধি ও ব্যাটিং মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। তাই আফসোস থেকেই যায়।
তারপরও একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, বাংলাদেশ এ আসরে ভারতকে হারাতে পারে, ভারতীয়দের জয় রথ থামানোর ক্ষমতা আছে টাইগারদের; এ সত্য অন্তত জানা হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আগের দুই ম্যাচে টাইগারদের শরীরি ভাষা ভালো ছিল। তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনায়ও ছিল দূরদর্শিতার ছাপ। বোঝা গেছে, তারা একটা লক্ষ্য পূরনের মিশনে নেমেছে।
এক ম্যাচে বোলাররা করণীয় কাজ করে উঠতে পারেননি। তাই লঙ্কানরা ২১৪ রানের পাহাড় গড়েছিল। আর পরের ম্যাচে শেষ দিকে মার খেলেও ১৫ ওভার পর্যন্ত ভারতীয়দের রানের লাগাম টেনে ধরার কাজটি করে দেখিয়েছেন বোলাররা। দুই ম্যাচেই মুশফিক একশতে একশ। বাকি ব্যাটসম্যানরা ভারতের সাথে জ্বলে উঠতে পারলে নির্ঘাত জয়ের দেখা মিলতো।
তার মানে আগের দুই ম্যাচে টাইগাররা দেখিয়েছে, ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে জিততে করণীয় কি কি? তা মোটামুটি জানা। যেদিন জায়গামত সেই কাজের যথাযথ ও বাস্তব প্রয়োগ ঘটছে, সেদিনই মিলছে জয়ের দেখা।
কাজেই সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটাতে পারলে টাইগাররা আবারো লঙ্কানদের হারাতে পারে, এমন বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হয়েছে। সে আস্থা ও সামর্থ্যে বিশ্বাসের সাথে আরও একটি ইতিবাচক বিষয় যোগ হতে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলে কাল লঙ্কানদের সাথে খেলতে পারেন টিম বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিং ‘নিউক্লিয়াস’ সাকিব আল হাসান।
সাকিব দলে আসার অর্থ ৩০ থেকে ৪০ ভাগ শক্তি বেড়ে যাওয়া। সাকিব দলে আসার অর্থ ব্যাটসম্যান বেড়ে যাওয়া। এ কয় ম্যাচে দুই স্পিনারের কোটা ঠিক রাখতে অফস্পিনার মিরাজের সাথে বাঁহাতি নাজমুল অপুকে খেলাতে হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটসম্যান সংখ্যা সাত থেকে কমে ছয়ে নেমে এসেছে।
এখন সাকিব আসায় খুব স্বাভাবিকভাবেই মিরাজ ও নাজমুল অপুর যে কোন একজনকে জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। তামিম, লিটন , সৌম্য, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ আর সাব্বিরের (তার বদলে আরিফুলও খেলতে পারেন) সাথে সাত নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলবেন সাকিব।
শুধু ব্যাটসম্যান বাড়াই নয়, দলের বোলিং শক্তিও বাড়বে বহুগুণে। কাজেই ‘টু ইন ওয়ান’ সাকিবের অন্তর্ভুক্তি মানেই আবার আগের মত করে একাদশ সাজানোর অবারিত সুযোগ। যে বা যারাই খেলুন , সাকিব দলে থাকার অর্থ, সাত সাত জন ব্যাটসম্যান দলে খেলা। আর তার কারণে কোন স্পেশালিস্ট স্পিনারেরও দরকার পড়ে না। বাঁহাতি স্পিনার হিসেবেও যে সাকিব এক নম্বর।
কাজেই সাকিব খেলা মানেই লাইন আপে স্থিতি ফিরে আসা। ব্যাটিং ও বোলিং শক্তি বৃদ্ধি। দলের বাকি ১০ ক্রিকেটারের মনোবল আর আস্থাও বেড়ে যাওয়া। সব মিলে ভালো কিছুর আশা করাই যায়। মরা নদীতে বাণ ডাকার মত হঠাৎ চাঙা টাইগারদের নিয়ে আবার স্বপ্ন ভক্তদের মনে।
কাল লঙ্কানদের হারিয়ে ফাইনালের টিকেট কনফার্ম করে সে স্বপ্নর বাস্তব রুপ দিতে পারবেন তামিম, লিটন , সৌম্য, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজরা? দেখা যাক।
এআরবি/এমএমআর/এমএস