ওয়ালশের কাছে ‘ক্রিকেট স্পিরিট’ই বড়
১৭ বছরের ক্যারিয়ার। নামের পাশে লেখা ৫১৯টি টেস্ট উইকেট। নির্ঝঞ্জাট এক পেস বোলার ছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। অবশ্যই কিংবদন্তি। ভদ্র ক্রিকেটারের প্রতিমুর্তি। সবচেয়ে বড় কথা ‘ক্রিকেট স্পিরিট’কে তিনি ঠাঁই দিয়েছেন নিজের সব কিছুর উর্ধ্বে। সে কারণেই, ১৯৮৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেলিম জাফর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরও তাকে রান আউট করেননি ওয়ালশ। কাজটা অন্যায় না হলেও ওয়ালশের কাছে ছিল নৈতিকতা বিরোধী। ছোটবেলা থেকে ন্যায়-অন্যায়ের সঙ্গে নৈতিকতারও দারুণ শিক্ষা পেয়েছেন তিনি! সেই ওয়ালশ তাই নিজের ক্যারিয়ারে সব কিছুর উপরে তুলে ধরেছেন ‘ক্রিকেট স্পিরিট’কেই।
কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের উদ্যোগে আয়োজিত পতৌদি স্মারক বক্তৃতায় এবারের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। কলকাতায় সেই স্মারক বক্তৃতা করতে গিয়ে ওয়ালশ ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেই ঘটনাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন, সেলিম জাফরকে রানআউট না করার কারণে এখনও তিনি অনুশোচনায় ভোগেন না। একই সঙ্গে বর্তমান সময়ে ক্রিকেট স্পিরিটের অনুপস্থিতি তাকে দুঃখ দেয় বলেও জানান।
কোর্টনি ওয়ালশ ক্রিকেট স্পিরিটের সঙ্গে মাঠে অধিনায়াকের ভূমিকাকেই মূখ্য হিসেবে গণ্য করেন। তাতে অধিনায়কের তারকাখ্যাতি থাক বা না থাক- সেটা কোনো বিষয় নয় বলেও জানান। বক্তব্যের শুরুটা করেছিলেন তিনি অধিনায়কের ভুমিকা নিয়ে। তিনি শুরু করেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজে আমি মাইকেল হোল্ডিংকে দেখে দেখে বড় হয়েছি। তিনি ছিলেন আমার আদর্শ। আমরা দু’জনই একই দ্বীপের, জ্যামাইকা। খেলেছিও একই ক্লাবে, মেলবোর্ন। এটা এমন এক ক্লাব, যারা অনেকগুলো নামকরা ক্যারিবীয় ক্রিকেটারের জন্ম দিয়েছে। যেমন মাইকেল হোল্ডিং, মারলন স্যামুয়েলস...। আমার প্রথম রুমমেটও ছিলেন হোল্ডিং। এ কারণে, নিজেকে মেলে ধরতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি আমার।’
দু’জন বিখ্যাত অধিনায়ক এবং ব্যাটসম্যানের সঙ্গে খেলেছেন ওয়ালশ। সেটা জানিয়ে বলেন, ‘আমি খেলেছি দু’জন বিখ্যাত ব্যাটসম্যানের সঙ্গে। যারা ভালো অধিনায়কও ছিলেন। স্যার ভিভ রিচার্ডস এবং ব্রায়ান চার্লস লারা। তারা দু’জন অনেক সফল হয়েছেন। সুতরাং, আমি মনে করি না যে একজন সফল অধিনায়ক হতে হলে সুপারস্টার তকমা থাকতে হবে। শুধু দরকার সময়মত আপনি ভালো কিছু শিখছেন এবং পরিণত হচ্ছেন। লারা শুরুর দিকে খুব দুঃসাহসিক ছিলেন না। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিণত হয়েছেন।’
লারার আর ভিভের মধ্যে পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে ওয়ালশ বলেন, ‘দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হলো ভিভ কখনোই হারতে চাইতেন না। সে খেলোয়াড় হিসেবে হোক কিংবা লিডার হিসেবে।’
ক্রিকেট দুনিয়ায় যখন ঝড় উঠেছে বিরাট কোহালির আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তখন অন্য রকম কথা বলে দিচ্ছেন কোর্টনি ওয়ালশ। বক্তৃতা ওয়ালশ বলেন, ‘কোহালি আবেগহীন একটা রোবট হয়ে যাক, চাই না। আমি বুঝতে পারছি না, লোকে বিরাটের আগ্রাসন নিয়ে কেন রাতের ঘুম ত্যাগ করছে। আমি তো ওকে টিভিতে দেখে নিজের মনেই বলি, ওহ্! এই ছেলেটা ক্রিকেটের জন্য দারুণ একটা চরিত্র।’
ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গেও তুলনা করলেন তিনি কোহলিকে। তিনি বলেন, ‘ভিভ রিচার্ডসও এ রকমই আক্রমণাত্মক ছিল। প্রত্যেকটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত জিততে চাইত। ভিভের অভিধানে হার বলে কোনও শব্দ ছিল না। আমি ভিভের ছায়া দেখতে পাই অধিনায়ক বিরাটের মধ্যে।’
দু’বছর আগে ভারত যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল, তখন সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওয়ালশের। তখন ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন অনিল কুম্বলে। যিনি তার ভাল বন্ধুও ছিলেন। এক রাতে কুম্বলের সঙ্গে ডিনারে গিয়েছিলেন ওয়ালশ। তখন কুম্বলে তাকে অনুরোধ করেন, ভারতীয় বোলারদের সঙ্গে এসে কথা বলার জন্য। যদিও সে সময়ে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, প্রতিপক্ষ কোচের আবেদনে সাড়া দিতে একবারও ভাবেননি ওয়ালশ। রাজি হয়ে যান।
এরপরে অধিনায়ক কোহালি স্বয়ং এসে তাকে আমন্ত্রণ জানান। যা দেখে ওয়ালশের মনে হয়েছিল, কোহলি খুবই সক্রিয় এক অধিনায়ক। যিনি শুধু নিজেই উন্নতি করতে চান না, দল হিসেবে ভারতেরও উন্নতি চান, ‘আমার মনে হয় সেই সফরে ভারতীয় পেসারদের মধ্যে ছিল মোহাম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমার, উমেশ যাদবরা; কিন্তু সে মিটিংয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সদস্যের নাম ছিল বিরাট কোহালি। সারাক্ষণ ও বসে থাকল শোনার জন্য যে, বোলারদের আমি কী বলি। সেদিন ক্রিকেটের এক মনোযোগী ছাত্রকে আমি দেখেছিলাম।’
এখানেই থেমে থাকেননি কোহলি। এরপর ওয়ালশকে অনুরোধ করেন, তুমি আমাকে ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে? ওয়ালশ সেই ব্যবস্থাও করে দেন। ভিভকে বলে দেন, বিরাট তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ভিভ রাজি হয়ে যান। পরের ম্যাচ ছিল অ্যান্টিগায়। ভিভের শহর। সেখানে দেখা হয়ে যায় ভিভ ও বিরাটের।
‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ নিয়ে বলতে গিয়ে সাতাশি বিশ্বকাপে সেলিম জাফরকে রান আউট না করার প্রসঙ্গ চলে আসে। সেদিন যদি সেলিম জাফরকে রানআউট করতেন ওয়ালশ, তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায়। কিন্তু তিনি সবার ওপর ঠাঁই দিয়েছেন স্পিরিট অব ক্রিকেটকে। তিনি বলেন, ‘যেভাবে আমি বেড়ে উঠেছি, মানুষকে ঠকাতে শিখিনি। তাই সেলিম জাফরকে সতর্ক না করে আউট করতে চাইনি। আমার আজও কোনও আক্ষেপ নেই এ নিয়ে। অধিনায়ক ভিভ রিচার্ডস এবং দলের সকলে আমাকে সমর্থন করেছিল।’
সদ্য সমাপ্ত নিউজিল্যান্ড যুব বিশ্বকাপে তারই দেশের দুই জুনিয়র ক্রিকেটার এই সুযোগ পেয়ে ওয়ালশের উদাহরণ অনুসরণ করেননি। তারা নন-স্ট্রাইকারকে আউট করে দিয়েছিলেন। যা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। বক্তৃতায় বলে ফেলেন, ‘যুব বিশ্বকাপে অন্তত ক্রিকেট স্পিরিটের কথা মনে রাখবে তরুণরা, এটাই আশা করেছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই ম্যাচে জিতে থাকতে পারে। সেদিন আইন লঙ্ঘন করেনি কেউ; কিন্তু ক্রিকেটীয় স্পিরিটকে হত্যা করা হয়েছিল। খেলায় জেতা দরকার; কিন্তু স্পিরিটকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।’
যার স্মরণে বক্তৃতা, তার সঙ্গে কখনও কথা হয়নি ওয়ালশের। এ কারণে বলে দিলেন, ‘পতৌদি কখনও চার আগুনে পেস বোলার টিমে পাননি। বদলে পেয়েছিলেন চার স্পিনার। তা নিয়েই তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের স্পিনের স্বর্ণযুগ তৈরি করেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পতৌদি একটা রণকৌশল গড়ে তুলেছিলেন জেতার জন্য এবং সফলও হয়েছিলেন।’ মজা করে বললেন, ‘টাইগারের ছিল চার স্পিনার। ক্লাইভ লয়েডের ছিল চার পেসার। আমি মনে করি অধিনায়ককে বিগ ব্রাদার হতে হয়; কিন্তু টাইগার এবং ক্লাইভ দু’জনেই হয়ে উঠেছিলেন বিগ ফাদার। আপন আপন রণকৌশলে দারুণ সফল হয়েছিলেন তারা।’
পতৌদিকে তিনি কখনও দেখেননি; কিন্তু লয়েডের অধীনে খেলেছেন। বলে ফেললেন, ‘আমি একটা সিরিজেই লয়েডের অধীনে খেলি। আমার অভিষেক সিরিজ। আর তাতেই বুঝে যাই, ক্লাইভ কেন এত বড় ক্যাপ্টেন। আমার মতো জুনিয়রকেও জিজ্ঞেস করেছিল, কী ধরনের ফিল্ডিং চাও। আমি তো শুনে অবাক হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম, ক্যাপ্টেন যা ফিল্ডিং সাজাবে সেই অনুযায়ী আমাকে বল করতে হবে।’
তার দেখা সেরা ক্যাপ্টেনদের মধ্যে ইমরান খানকে রাখছেন ওয়ালশ। যিনি পতৌদি স্মারক বক্তৃতায় প্রথম বক্তা হিসেবে এসেছিলেন। ‘আমার মতে বড় অধিনায়ক মানে সে বিপ্লব আনবে ক্রিকেটে। পরিবর্তন রেখে যাবে। ইমরান পাল্টে দিয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেটে। আমি যতটুকু শুনেছি, পতৌদিও একই রকম ছিল। আমার মনে হয় ইমরান এবং টাইগারের অধিনায়কত্বের ধরনের মধ্যে অনেক মিল ছিল।’
কপিল দেবকে টপকে টেস্টে বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছিলেন তিনি। সেরা পুরস্কার হিসেবে এখনও মনে রেখেছেন কপিলের ফোন। ‘ভারত থেকে জ্যামাইকায় ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিল। জীবনে ভুলতে পারব না’- বলে তিনি যোগ করছেন, ‘সঙ্গে দারুণ একটা প্রস্তাবও দিয়েছিল কপিল। জানি না কেন, আইসিসি এখনও এটা ভেবে দেখল না। কপিল বলেছিল, রেকর্ড ভাঙা হলে পুরনো রেকর্ডের মালিক কোনও স্মারক তুলে দিক নতুনের হাতে। তাহলে দু’জনেই তো স্বীকৃতি পায়। আমার মনে হয়, এটা দারুণ একটা প্রস্তাব ছিল।’
তিনি জামাইকার তারকা। মাইকেল হোল্ডিং একই দ্বীপ থেকে উঠে এসেছিলেন। হোল্ডিংই ছিলেন ওয়ালশের আদর্শ। জামাইকা মানে স্যাবাইনা পার্ক। যেখানে এক সময় বিশ্বের দ্রুততম এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক পিচ হতো। ওয়ালশের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। মজা করে বলে দিলেন, ‘স্যাবাইনা পার্কের আশেপাশে অনেকগুলো ভাল হাসপাতাল আছে। আর যখনই ক্রিকেট ম্যাচ থাকত, হাসপাতালগুলো খুব ব্যস্ত হয়ে উঠত। প্রচুর লোক আহত হয়ে সাবাইনা পার্ক থেকে হাসপাতালে ছুটত।’
একটি বিশেষ ম্যাচের কথা তার মনে পড়ছে। ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ চলছিল। প্যাট্রিক প্যাটারসন পাঁচজনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। কারও হাত ভাঙা, কারও নাক ফাটা, কারও আঙুল মটকে গিয়েছে। তারপর যখন ওরা ব্যাট করতে এল, আরও তিনজন আহত হল। তখন অন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হল। কারণ আগেরটাতে আর কোনও বেড খালি পড়ে ছিল না।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে নিদাহাস ট্রফিতে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কায়। তিনি আশাবাদী, বাংলাদেশ উজ্জীবিত পারফরম্যান্স করবে। দারুণ কিছু ফাস্ট বোলার উঠে আসছে বাংলাদেশে, এমন মন্তব্যও করলেন তিনি।
‘টাইগারকে কখনও খেলতে দেখিনি। শুধু শুনেছি; কিন্তু টাইগার পতৌদি স্মারক বক্তৃতায় আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই আমি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে উত্তীর্ণ হলাম। তাই বলব, টাইগার, তুমি আমার জন্য লাকি ক্যাপ্টেন!’ শেষ করলেন ওয়ালশ। গ্র্যান্ড হোটেলের বল রুমে হাততালি আর উচ্ছ্বাসের বহর দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন সেই ১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ফিরছেন!
আইএইচএস/পিআর