মিডিয়ার কারণে ক্রিকেট আটকে আছে!
ঢাকা টেস্টে শ্রীলঙ্কার কাছে মাত্র আড়াই দিনে ২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারের পরই আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। কেন এভাবে হারলো- এর চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সবচেয়ে বেশি সরব সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক, টুইটারে ব্যবচ্ছেদটা এমনভাবে হচ্ছে, যাতে বাংলাদেশের এই পরাজয়ের জন্য টিম ম্যানেজমেন্টই যেন পুরোপুরি দায়ী। মিডিয়ায়ও আসছে নানা ব্যাখ্যা। যার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টকে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার আক্রমণের তিরটা সবচেয়ে বেশি গিয়ে আঘাত হানছে দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনকে।
মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার আক্রমণে জর্জরিত টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন এবার নিজের সব ক্ষোভ উগড়ে দিলেন মিডিয়ার ওপর। মিডিয়ার ওপর এতটা ক্ষুব্ধ হলেন যে তিনি বলেই বসলেন, ‘মিডিয়ার কারণে আমাদের ক্রিকেট আটকে আছে কি না সেটাও দেখতে হবে।’
সোশ্যাল মিডিয়ার আক্রমণে আহত বাঘের মত হয়ে গেলেন যেন খালেদ মাহমুদ সুজন। ক্ষোভ থেকেই তিনি বলে বসলেন, ‘আমার আসলে নোংরা লাগছে সত্যি কথা বলতে গেলে।’ এ কারণে তিনি জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গেই আর কাজ করতে আর আগ্রহী নন। তিনি বলেন, ‘পারসোনালি আমি আর আগ্রহী না। আমার আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গেই কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। আমার আসলে নোংরা লাগছে সত্যি কথা বলতে গেলে ওইভাবে। এতবছর বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে কাজ করছি, বাংলাদেশের উন্নতির জন্যই কাজ করছি। এখানে আমার কোন স্বার্থ নাই। আমি আর আগ্রহী না।’
খালেদ মাহমুদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নোংরা বলতে আসলে কোনটা বোঝাচ্ছেন? জবাবে মিডিয়ার দিকেই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। মিডিয়ায় দলের বাজে পারফরম্যান্স নিয়ে যা লেখা হয়েছে তাতে তিনি খুব বিরক্ত। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপরও রাগ রয়েছে তার।
নোংরা বলতে কী বোঝাচ্ছেন এর জবাবে তিনি বলেন, ‘সবকিছুই। আমার কথা হচ্ছে সব কিছুই। এটা আসলে বলার কিছু নাই। আপনারাও জানেন, আমরাও জানি। নোংরা বলতে গেলে, মিডিয়াতে যেভাবে লেখা হয়। আমাদের ক্রিকেটের বড় অন্তরায় হচ্ছে, মিডিয়ারও একটা ব্যাপার আছে যে আমরা এত ফিশি হয়ে যাচ্ছি। এখন মিডিয়া ফিশি। মিডিয়ার কারণে আমাদের ক্রিকেট আটকে আছে কি না সেটাও দেখতে হবে। এটা তো বেশি মিডিয়াতে এখন...।’
বাক্যটা শেষ করলেন না খালেদ মাহমুদ। পরক্ষণেই নিজের দিকে কথাটাকে টেনে নিয়ে মিডিয়াকে কিছু উপদেশও দিলেন। জানালেন একজন খেলোয়াড় কিভাবে তৈরি হয় সেই প্রসেসের কথাও। সুজন বলেন, ‘আসলে বেসিক ফিল আমার, ক্রিকেট আমরা এতবছর ধরে খেলছি। এখন এত গসিপিং হয় । মিডিয়াতে ভাল খারাপ সবই হবে; কিন্তু কিছু কিছু জিনিস নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটের জন্য খুব কঠিন। একটি ছেলেকে তুলে নিয়ে আসা এত সহজ না। একটা ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে তাকে তৈরি করে তোলা অনেক কঠিন। কোচ কাজ করে, নাইনটিন দল, এইচপি অনেক কিছু। এই কথাগুলো যদি ঠিক না হয় তাহলে আমার মনে হয় না বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক দূর যাবে।’
প্রশ্ন আসলো, আর যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নন বলেছেন, মিডিয়ার উপর রাগ করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? জবাবে আরও আবেগি হয়ে ওঠেন খালেদ মাহমুদ সুজন। জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট খেলে এবং ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার পর এমন শুনতে হবে, তা তিনি কল্পনাও হয়তো করতে পারছেন না। বিশেষ করে তার নিজের নিবেদন নিয়ে কথা উঠলে সেটা খারাপই লাগে।
সুজন বলেন, ‘আমি তো গড না। আমি তো খালেদ মাহমুদ সুজন। আমি খুবই সামান্য একটা মানুষ। আমি মনে করি আমার সামর্থ্য, আমি এখানে দাঁড়িয়ে কাজ করেছি মানুষ স্বীকার করুক না করুক- আমি এটা ভালোবাসি। আমি যখন শুরু করছি আপনারা হয়ত তখন খুব ছোট। জানেন না, হয়ত জানার কথাও না। আমি যখন শুরু করি ১২-১৩ বছর বয়সে। অন্য কিছু নিয়ে কথা বললে আমার মেজাজ খারাপ হতে পারে। টেকনিক্যাল হয়ত খারাপ হতে পারি; কিন্তু অন্য বিষয় নিয়ে যখন কথা বলে, তখন এটা আমাকে খুবই আহত করে।’
চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ বল খেলে ৯ রান করে ম্যাচ বাঁচানোর ক্ষেত্রে দারুণ অবদান রাখার পরও মোসাদ্দেককে বসিয়ে রেখে ঢাকায় সাব্বিরকে খেলানোর ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুঞ্জন উঠেছে- এটা খালেদ মাহমুদ সুজনের কারণেই হয়েছে। সুজন আবাহনীর কোচ। এ কারণে মোসাদ্দেক যেন প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়ে খেলতে পারে, সে জন্য ঢাকা টেস্টের দলে রাখা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি যখন সুজনকে এভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন বিষয়টা তার জন্য খারাপ লাগারই। তিনি এরই প্রতিবাদ করে কথা বললেন।
সুজন বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে যখন আসে যে, আমি আবাহনীর হেড কোচ। আমি মোসাদ্দেককে খেলাইনি এ কারণে যে, আবাহনীতে খেলার জন্য। যখন ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট নিয়ে কথা বলে তখনই এটা খুবই আহত করে। আমি মনে করি না, বাংলাদেশের থেকে আবাহনী বা অন্য কিছু আমাকে টাচ করতে পারে। জীবনেও ছুঁতে পারবে না, ছুঁতে পারেওনি। এ গুলা নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন আহত হই খুব। তখন মনে হয় এত বছর ক্রিকেটের সঙ্গে থেকে আসলে কি লাভটা হল! মোসাদ্দেক আর আবাহনী যদি বাংলাদেশের ম্যাচ হারার কারণ হয়ে যায়। তাহলে খুব কঠিন আসলে। ৫৩ বলে ৯ রান করছে আমিও দেখছি। আমারও ক্রিকেট নলেজ আছি, আমিও দেখছি। ৮৩ সালে ক্রিকেট খেলা শুরু করছি। অনেক বছর হয়েছে। চুলও পাইকা গেছে এখন। কে পারে, কে পারে না। কখন কাকে দরকার। এটা আমরাও বুঝি। আপনারা হয়ত আরও ভালো বুঝেন। এতকুট বোঝার ক্ষমতা আছে।’
এরপর আবারও কিছুটা আবেগি সুজন। আগের কথাটাই টেনে আনলেন তিনি। বললেন, ‘এটা মনে হয় যে আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভাল কিছু করছি না। তাহলে আমার এখানে থেকে লাভটা কি। স্বার্থের জন্য আসিনি। আমার যা আছি আমি খুব ভালো আছি। আমি খুব খুশি, এখানে চাকরি করি, যতটুকু পাই, বা যেভাবে চলি।’
আবারও প্রশ্ন উঠলো, তাহলে মিডিয়ার দাবি মেনে নিচ্ছেন? জবাবে তিনি, মিডিয়ায় যা এসেছে তা মানতে রাজি নন বলে জানান। তার ব্যখ্যা, মিডিয়া ভিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে কারণে, মিডিয়া তাদের পেছনে লেগেছে।
খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, ‘না, মিডিয়ার দাবি মানছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনারা এটা স্টাবলিশ করতে চান। চন্ডিকা চলে গেল কেন- এটা স্টাবলিশ করানো হইছে। আমরা তো বাচ্চা খোকা না এখন। সবাই তো বড় হইছি। অনেক কিছু স্টাবলিশ করা হয়। আমার পিছে যদি লাইগা থাকা হয়, আমি কোনদিন ভালো করলেও ভাল হব না। এত বছর খালি ভাল করতে তো শুনি নাই। সোশ্যাল মিডিয়া বলেন, মিডিয়া বলেন। আজকে এমনও শুনছি যে- রাস্তায় গেলে আমাকে মারও খেতে হতে পারে। তো ক্রিকেট খেলার জন্য মার খেতে হলে- এটা তো অকওয়ার্ড আসলে। কথার কথা বলছি।’
মিডিয়া না সোশ্যাল সাইট- কোনটাকে আসলে সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন খালেদ মাহমুদ সুজন। কার ওপর ক্ষুব্ধ বেশি তিনি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব কিছুই। আমার কথা হলো কি দেখেন, মানুষের আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। ড্রেসিং রুমের কাঁচের ভেতর কি হয়। কাঁচের ভিতরে বসে খেলা দেখা, আর মাঠে এসে খেলা। আমরা যারা খেলছি। যতই আমরা প্লানিং দেই। প্রেসার সিচুয়েশন আসে যখন বড় ব্যাটসম্যানও ভুল করে। এটা কেউ মানতে পারে না। আমরা মনে করি আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল। আমরা সব কিছুই জিতব। এই কাঁচের ভিতর থেকে যারা কাজ করি তাদের জন্য এতটা ইজি না আসলে। আমি ইমোশনাল হয়ে গেছি হয়তবা। আশা ছিল এই সিরিজটা জিতব। ওয়ানডেতে যেভাবে শুরু করেছিলাম, জেতা উচিত ছিল।’
তবে খালেদ মাহমুদ এটা জানিয়ে দিলেন, এই পরাজয়ের জন্য তিনি কোনো অজুহাত দিতে চান না। টার্নিং উইকেটের যে অজুহাত তোলা হচ্ছে সেটাও মানতে রাজি নন তিনি। সুজন বলেন, ‘আমি কোন অজুহাত দিতে চাই না। টার্নিং উইকেট, বাউন্সি উইকেট- এসব কিছুই না। আমি যদি প্লেয়ার হই, সব উইকেটে ভালো খেলার কথা। উইকেট নিয়ে দোহাই দিয়ে লাভ নাই।’
দায় নিজেদের ঘাড়েই রাখতে চাইলেন সুজন। তিনি বলেন, ‘রোশেন সিলভা সেকেন্ড টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, সে এত ভাল খেললো কেমনে? ওর কাছে উইকেটটা টাফ না? হি স্ট্রাগল, হি ফাইটস। আমি তো ফাইট দেখি না। আমি তো দেখি না অনেকক্ষণ স্ট্রাগল করে ব্রিলিয়ান্ট একটা ডেলিভারিতে আউট হয়েছে- এমন তো হয় নাই (আমাদের ক্ষেত্রে)।’
ব্যাটসম্যানদের ওপরই সব দোষ চাপালেন খালেদ মাহমুদ। উইকেটের দোহাই আসলে তার মতে একটা অজুহাত। যেখানে শ্রীলঙ্কা পারে, সেখানে আমাদের না পারার কিছুই নাই। মোট কথা, আমাদের মধ্যে একটা জুজু প্রবেশ করেছে। সে কারণেই আমরা পারিনি।
খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘আসল ব্যাপার কি, একজন বললে এটা ছোঁয়াচের মত হয়। দশজন বললেও হয়, উইকেট এভাবে বানানো উচিত হয়নি। উইকেট যে এমন হবে এটা ১৫-২০ দিন আগে থেকে সবাই জানে। এই ইনফরমেশন ছিল সবার কাছে যে আমরা এই উইকেটে যাচ্ছি। তবে আমরা আনলাকিলি যে চিটাগংয়ে এই উইকেট হওয়ার কথা ছিল, হয় নাই। সেটা যে কারণেই হোক, হয় নাই। তারপর ঢাকায় হয়েছে সেটা আমরা জানতান যে, হবে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে টার্নিং উইকেটে খেলা যাবে কেন শ্রীলংকা কি গড? এমন কি আছে শ্রীলঙ্কার সাথে আমরা খেলতে পারবো না? ব্যাটিং লাইনআপ যদি দেখেন, কুশল মেন্ডিস, ধনঞ্জয়া- এরা কে কয়টা টেস্ট ম্যাচ খেলেছে? আমাদের স্ট্রেংথ তাদের স্ট্রেংথ (তুলনা করুন)। আমাদের স্পিনার নেই। বলতে পারেন আমাদের সাকিব নেই। আমাদের রাজ্জাক ৫০০ উইকেট পাওয়া ফার্স্ট ক্লাস বোলার। কিভাবে বলবো অভিজ্ঞতা নেই? তাইজুলকে যদি দেখেন- আকিলা ফার্স্ট টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫ উইকেট নিলো। তাইজুল তো আরও বেশি খেলতেছে। মিরাজ ইংল্যান্ডের সাথে ১৯ উইকেট নিয়েছে। আমরা কিভাবে বলবো আমাদের অভিজ্ঞতা নেই! আমার কথা হলো আমরা কেউ এই জিনিসগুলো চিন্তা করি না। আমরা বলি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের উচিত হয়েছে কী না (এমন উইকেটে খেলা)। না হবে না? শ্রীলঙ্কা কি গড? ওদের প্লেয়াররা কি গড? ওরা কি স্টিভেন স্মিথ? বা এরকম কিছু যে- ২০০ টেস্ট ম্যাচ খেলা প্লেয়ার। কেন এগুলো চিন্তা করি না যে, আমাদের প্লেয়াররাই ভুল খেলেছে?’
সিরিজ নিয়ে ময়না তদন্ত করা হবে কি না জানতে চাইলে খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘আমি যেতে চাই না এগুলাতে। কাটাছেঁড়া করলে অনেক কিছুই কাটাছেঁড়া করা হয়। একটা দলের ভাল-মন্দ একটা দলের ভেতরকার কথা। টিমে এখানে অনেক কিছু হতে পারে। আমরা হারছি এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। সেটাতে আমরা কোচরা এসে বলবো না। আমাদের বলার দরকার নেই। বাইরে থেকও বলা দরকার নেই। আমরা খেলায় হেরেছি, মেনে নিতে হবে। আপনি গায়ের জোরে বলতে পারবেন না যে, ফ্ল্যাট উইকেট হলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত। আপনি এটা বলতে পারবেন যে ফ্ল্যাট উইকেট হলে শ্রীলঙ্কার সাথে আবার টেস্ট ম্যাচ হলে আবার চ্যাম্পিয়ন হবো এটা বলতে পারবেন আপনি? এর গ্যারান্টি নেই। এটা হলো আপনার এক্সিকিউশন, আপনি কিভাবে খেলবেন। আমরা অস্ট্রেলিয়ার সাথে ইংল্যান্ডের সাথে যদি জিততে পারি শ্রীলঙ্কার সাথে হারের কারণ তো উইকেট হতে পারে না।’
আইএইচএস/আইআই