রাজ্জাক-তাইজুলের ঘূর্ণিতে ২২২ রানে থামল শ্রীলঙ্কা
ঢাকার উইকেট কেমন হবে, ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই এই প্রশ্ন ছিল সবার মুখে মুখে। তবে ম্যাচ শুরুর পর বোঝা গেলো, পুরোপুরি স্পিন বান্ধব। শুরুতেই বলে যেভাবে টার্ন কিংবা আন-ইভেন বাউন্স- তাতে দু’তিনদিন পার হওয়ার পর এই উইকেটের অবস্থা কী হবে তা ভাবতেই অনেকটা শিউরে উঠবেন ব্যাটসম্যানরা। এই উইকেটেই ঘূর্ণি ঝড় তুললেন চার বছর পর টেস্ট একাদশে ফেরা আবদুর রাজ্জাক রাজ এবং নিয়মিত স্পিনার হিসেবে দলে থাকা তাইজুল ইসলাম।
রাজ্জাক-তাইজুলের স্পিন তোপে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২২২ রানেই থেমে গেলো শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস। দিনের ৬৬তম ওভার পর্যন্ত খেলতে পেরেছে কেবল দিনেশ চান্ডিমালের দল। রাজ্জাক এবং তাইজুল- দু’জনই নিয়েছেন ৪টি করে ৮টি উইকেট। বাকি দুই উইকেট নিয়েছেন পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। মেহেদী হাসান মিরাজ থাকলেন পুরোপুরি উইকেটশূন্য।
লঙ্কানদের হয়ে সর্বোচ্চ ৬৮ রান করেন ওপেনার কুশল মেন্ডিস। এছাড়া রোশেন সিলভা ৫৬ রান করে লঙ্কানদের স্কোর ২০০ পার করে দেন।
স্পিনার আবদুর রাজ্জাকে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। সাকিব আল হাসানের না থাকাটা বুঝতেই দিচ্ছেন না বাংলাদেশের বামহাতি স্লো অর্থোডক্স আবদুর রাজ্জাক। চার বছর পর টেস্ট একাদশে ফিরে তিনি যে এতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠবেন, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল! রাজ্জাক নিজেও হয়তো এতটা ভাবেননি। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংটাই করে ফেললেন তিনি। লঙ্কানদের চারজন ব্যাটসম্যানকে পাঠিয়েছেন তিনি সাজঘরে। ৯৩ রান দিয়ে রাজ্জাকের সেরা বোলিং ছিল ৩ উইকেট। এবার সেই ক্যারিয়ার সেরা বোলিং চাপিয়ে গেলেন তিনি। ৬৩ রানে নিলেন ৪ উইকেট।
টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় শ্রীলঙ্কা। ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শেষবারের মত সাদা জার্সি পরেছিলেন রাজ্জাক। এর ঠিক চার বছর পর আবারও টেস্ট দলে ফেরেন স্লো বাম হাতি এই অর্থোডক্স স্পিনার। দলে ফিরেই চমক দেখিয়ে দিলেন আবদুর রাজ্জাক রাজ। শ্রীলঙ্কান শিবিরে শুরুতেই আঘাত হানলেন অভিজ্ঞ এই স্পিনার। স্পিন ভেলকিতে পরাস্ত করলেন লঙ্কান ওপেনার দিমুথ করুনারত্নেকে।
ইনিংসের ৬ষ্ঠ ওভারের প্রথম বলেই করুনারত্নেকে ফাঁদে ফেলেন তিনি। রাজ্জাকের বলে ফ্লিক করতে ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে আসেন করুনারত্নে। ব্যাট ফাঁকি দিয়ে দুই পায়ের মাঝ দিয়েই বল চলে গেলো উইকেটের পেছনে লিটন কুমারের হাতে। সুযোগটা সঙ্গে সঙ্গেই কাজে লাগিয়ে দিলেন লিটন। ফেলে দিলেন করুনারত্নের বেলস। স্ট্যাম্পিং হয়ে গেলেন তিনি। ১৪ রানের মাথাতেই পড়লো শ্রীলঙ্কার প্রথম উইকেট। সেই উইকেটটি এনে দিলেন অভিজ্ঞ স্পিনার আবদুর রাজ্জাক রাজ।
রাজ্জাকের দেখানো পথেই হাঁটলেন আরেক স্পিনার তাইজুল ইসলাম। দলীয় ১৪ রানে প্রথম উইকেট পড়ার পর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন কুশল মেন্ডিস আর ধনঞ্জয়া ডি সিলভা। মেহেদী হাসান মিরাজের ওপরই অনেক বেশি চড়াও হয়ে খেলতে শুরু করেন কুশল মেন্ডিস। ৪৭ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন তারা দু’জন। তবে তাইজুলের বলে সাব্বির রহমানের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যেতে হলো ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে। দলীয় ৬১ রানের সময় তাইজুলের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে সাব্বির রহমানের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ধনঞ্জয়া। এ সময় তিনি ব্যাট করছিলেন ১৯ রান নিয়ে।
৬১ রানে দ্বিতীয় উইকেট পড়ার পর একটি মাঝারিমানের জুটি গড়েন মেন্ডিস আর গুনাথিলাকা। এরই মধ্যে রাজ্জাককে বিরতি দিয়ে তাইজুল, মোস্তাফিজ এবং মেহেদী হাসান মিরাজকে দিয়ে বল করার অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ইনিংসের ২৮তম ওভারে আবারও রাজ্জাকের হাতে বল তুলে দেন টিম বাংলাদেশের অধিনায়ক। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসেই আরও দুর্বার হয়ে উঠলেন রাজ্জাক।
এ সময় পরপর দুই বলে তিনি ফিরিয়ে দিলেন শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যানকে। দানুশকা গুনাথিলাকা এবং অধিনায়ক দিনেশ চান্ডিমালকে দেখিয়ে দেন সাজঘরে ফেরার পথ। শুধু তাই নয়, দারুণ এক হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও তৈরি করেছিলেন তিনি। যদিও রোশেন সিলভা এসে রাজ্জাককে আর হ্যাটট্রিকটি করতে দিলেন না।
২৮তম ওভারের প্রথম বলেই রাজ্জাকের করা বলটি হালকা লাফিয়ে উঠেছিল। বুঝতে না পেরে পেছনের পায়ে ভর করে শট খেলেছিলেন গুনাথিলাকা; কিন্তু সেটি উঠে যায় মিড অফে। সেখানে দাঁড়ানো ছিলেন মুশফিক। মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া বলটি লাফিয়ে উঠে ঠিকই তালুবন্দী করে ফেললেন তিনি। পতন ঘটলো লঙ্কানদের তৃতীয় উইকেটের।
পরের বলে খেলতে নামেন দিনেশ চান্ডিমাল। লঙ্কানদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। রাজ্জাকের ফুল লেন্থের বল হালকা ইনসুইং করে ভেতরে ঢুকেছিল। ব্যাট পেতে দিয়েছিলেন চান্ডিমাল। কিন্তু টার্ন বুঝতে পারেননি তিনি। ফলে ব্যাট ফাঁকি দিয়ে গিয়ে সোজা বলটি আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। বোল্ড হয়ে গেলেন লঙ্কান অধিনায়ক। ৯৬ রানে সফরকারীদের বসিয়ে রেখেই পরপর ২ উইকেট তুলে নিলেন রাজ্জাক। অর্থ্যাৎ এ সময় শ্রীলঙ্কার রান দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৯৬।
১০৫ রানে লাঞ্চ বিরতিতে যায় দুই দল। লাঞ্চ বিরতি থেকে ফিরে এসেই আবারও ব্রেক থ্রু এনে দেন রাজ্জাক। শুরু থেকে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকলেও একপাশ আগলে রেখে লঙ্কানদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন কুশল মেন্ডিস; কিন্তু লাঞ্চ বিরতির পর ব্যাট করতে নেমেই রাজ্জাকের ঘূর্ণির সামনে আর টিকতে পারলেন না তিনি।
ওভারের প্রথম বলে রাজ্জাককে বাউন্ডারি মারেন মেন্ডিস। পাল্টা আক্রমণে পরের বলেই বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এই স্পিনারের ঘূর্ণি ফাঁদে পড়েন তিনি। বল আউট সুইং করে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে ফেলে দিয়ে গেলো অফ স্ট্যাম্পের বেলস। ৯৮ বলে ১০ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় ৬৮ রান করেন মেন্ডিস।
এরপরের ওভারেই তাইজুলের স্লো এবং লো বলে পরাস্ত হলেন নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামা নিরোশান ডিকভেলা। তাইজুলের বল মাটি থেকে বলতে গেলে উঠেইনি। লো বলটি গিয়ে সোজা আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। ১ রান করেই ফিরতে বাধ্য হলেন লঙ্কান উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।
রাজ্জাকের ঘূর্ণিতে যখন দিশেহারা লঙ্কানরা, তখন রোশেন সিলভা এবং কুশল পেরেরা মিলে ৫২ রানের জুটি গড়ে চেষ্টা করছিলেন বিপর্যয় সামাল দেয়ার; কিন্তু স্পিন ঘূর্ণির সামনেই পরাস্ত হতে হলো এই জুটিকে। ৫৫ বলে ৩১ রান করে কুশল পেরেরা ফিরে গেলেন মুমিনুল হকের ক্যাচ হয়ে।
যদিও তার এই আউট নিয়ে কিছুটা ধুম্রজাল তৈরি হয়েছিল। তাইজুলের বল খুব ভালোভাবে ডিফেন্স করার চেষ্টা করেন পেরেরা। বল প্যাডে লাগা মাত্রই জোরালো আবেদন এবং আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে জানিয়ে দিলেন আউট। রিভিউ নেন পেরেরা। রিভিউতে দেখা গেলো, প্যাডে লাগার আগে বল লেগেছিল ব্যাটে। শুধু এলবি হলে তো এটা আউটই না। কিন্তু প্যাডে লাগার পর বল সিলি পয়েন্টে ধরা পড়ে মুমিনুলের হাতে। সুতরাং, ব্যাটে লাগার কারণে ক্যাচ আউট! রিভিউতেও আউট হয়ে গেলেন পেরেরা।
দুই স্পিনার আবদুর রাজ্জাক এবং তাইজুল ইসলামের ঘূর্ণি ভেলকির মাঝেও উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন একমাত্র পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু তার বলে ওঠা ক্যাচ স্লিপে ছেড়ে দিয়েছিলেন সাব্বির রহমান রুম্মন। তবে, স্পিনারদের প্রভাব বিস্তারের দিনে একেবারে শূন্য হাতে থাকতে হলো না পেসার মোস্তাফিজকেও। তার বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন আকিলা ধনঞ্জয়া। ২৬ বলে তিনি করেছেন ২০ রান।
মোস্তাফিজের স্লোয়ারের কাছেই মূলতঃ ধরাশায়ী হলেন আকিলা ধনঞ্জয়া। তার বলে ক্যাচ তুলেছিলেন মিড অফে। প্রায় ড্রাইভ দিয়ে সেই ক্যাচ ধরেন মুশফিকুর রহীম। শ্রীলঙ্কার রান ছিল এ সময় ২০৫ রান। এরপরই অবশ্য দ্বিতীয় সেশনের খেলা শেষ হয়ে যায়।
তৃতীয় সেশনের শুরুতেই মোস্তাফিজের শিকারে পরিণত হন রঙ্গনা হেরাথ। মোস্তাফিজের বলে ক্যাচ তুলে দেন তিনি। ক্যাচ নেন মুশফিকুর রহীম। রোশেন সিলভা একপ্রান্ত আগলে রাখলেও শেষ পর্যন্ত ৬৬তম ওভারে তাইজুলের বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান। ৫৬ রান করে আউট হন তিনি। সে সঙ্গে তাইজুলের নামের পাশেও যোগ হয় ৪ উইকেট।
আইএইচএস/আইআই