দাপট দেখিয়ে ড্র বাংলাদেশের
ড্রেসিংরুমে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মুখটা পান্ডুরের মত দেখাচ্ছিল। তার সাজানো ছকেই যে চট্টগ্রাম টেস্টের চারটা দিন কেটে গিয়েছিল! আর তো বাকি মাত্র একটা দিন। এই একটা দিনও যদি পরিকল্পনা মতো এগোয়, তাহলে ঐতিহাসিক এক টেস্ট জয় হয়ে যাবে তার জন্য; কিন্তু হাথুরুসিংহে কী ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন, তারই হাতে বার বার উপেক্ষিত হতে থাকা মুমিনুল হক নামের এক লিটল বয়, টেস্ট ম্যাচটা বাঁচিয়ে দেবে!
মুমিনুল প্রথম ইনিংসে না হয় নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন। তাই বলে দ্বিতীয় ইনিংসেও! কিংবা লিটন দাসের মত ব্যাটসম্যান, প্রথম ইনিংসে যে বোকার মত বল ছাড়তে গিয়ে বোল্ড হয়েছিল প্রথম বলেই, সেই কি না হাথুরুর সাজানো বাগান তছনছ করে দেবেন! সব শেষে তারা পারলেন। পারলেন ম্যাচটাকে বাঁচিয়ে দিতে। বীরের মত লড়াই করে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র করলো বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেটে ৩০৭ রান। দিনের খেলা প্রায় ১৭ ওভার বাকি থাকতে যখন দেখা গেলো আর কারও জয়ের সম্ভাবনা নেই, তখন ম্যাচ সমাপ্তির আহ্বানই জানালেন দু’দলের দুই অধিনায়ক। আম্পায়াররাও ম্যাচ অমিমাংসিতভাবে শেষ করার ঘোষণা দিলেন।
ক্রিকেট এ কারণেই তো গৌরবময় অনিশ্চিয়তার খেলা। শেষ বল না হওয়া পর্যন্ত যে খেলা নিয়ে আগাম কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। চতুর্থদিন শেষ বিকেলে পাকা ফলের মত টপাটপ তিন উইকেটের পতন ঘটলে বাংলাদেশ শিবিরে হারের শঙ্কা জেগেছিল ঠিক; কিন্তু ছোট শরীরে বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মুমিনুল হক যেন ধনুভঙ্গ পণ করেই শেষ দিন ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিলেন। নিজের উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্রটা তিনি শুনিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী লিটন কুমার দাসকেও। তাদের দু’জনের পরিকল্পনাই ছিল যেন, হাথুরুর সাজানো বাগান নষ্ট করে দেয়া।
সে কাজে তারা পুরোপুরি সফল। ১৮০ রানের অতিমানবীয় জুটি গড়ে শ্রীলঙ্কার হাতের মুঠো থেকে ম্যাচটি পুরোপুরি বের করে নিয়ে আসলেন তারা দু’জন। একই টেস্টের দুই ইনিংসে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গৌরবময় সেঞ্চুরি উপহার দিলেন লিটল মাস্টার মুমিনুল হক। সঙ্গে লিটন কুমার দাস খেললেন অমিত সাহসী একটি ইনিংস। আক্ষেপ তার জন্য। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটার ঠিক ৬ রান আগেই আউট হয়ে গেলেন; তবে ব্যাক্তিগত অর্জনের চেয়ে দলীয় অর্জণকেই রাঙিয়ে দিলেন তিনি। তার ৯৪ রানের এই ইনিংসটি বাংলাদেশের ম্যাচ বাঁচানোর ক্ষেত্রে কম ভূমিকা রাখেনি।
প্রথম ইনিংসে ৫১৩ রান করেও ২০০ রানে পিছিয়ে পড়তে হলো লঙ্কানদের ৭১৩ রানের কারণে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে লঙ্কান স্পিনারদের খুব হিসেবি বোলিং আর টাইট ফিল্ডিংয়ের কারণে দলের বাটিং স্তম্ভ বলে পরিচিত তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস কিংবা মুশফিকুর রহীমের উইকেট হারানোর পর ৫ম দিনটাকে বাংলাদেশের জন্য মনে হচ্ছিল বিশাল লম্বা একটি দিন।
১১৯ রানে পিছিয়ে থেকে চতুর্থ দিন শেষ করে বাংলাদেশ। হাতে মাত্র ৭টি উইকেট। ক্রিজে আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলছিলেন কেবল মুমিনুল হক। তখন তার রান ১৮। পঞ্চমদিন ব্যাট করতে হবে রঙ্গনা হেরাথের মত বিশ্বের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি স্লো অর্থোডক্স স্পিনারকে মোকাবেলা করতে হবে। যে কি না এমন পরিস্থিতিতে বার বার প্রতিপক্ষের সামনে ভয়ঙ্কর রূপে হাজির হন। তারওপর বাংলাদেশ শিবিরে মুমিনুলছাড়া আর কোনো বাম হাতি ব্যাটসম্যান ছিল না। সবাই ডানহাতি। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের নামনে বাম হাতি স্পিনার দারুণ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন।
সেই হেরাথ, সান্দাকান, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা, দিলরুয়ান পেরেরা, লাহিরু কুমারা, কুশল মেন্ডিস কিংবা সুরঙ্গা লাকমালদের চারদিকে খেলে ১৮০ রানের বিশাল জুটি গড়রলেন মুমিনুল আর লিটন কুমার দাস। ১০৫ রান করে মুমিনুল যখন আউট হলেন, তখন দলীয় রান ২৬১অ। ততক্ষণে লঙ্কানদের হাত থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। তখন শুধু লক্ষ্য ছিল কতটা নিরাপদ দুরত্বে যাওয়া যায়।
লিটন কুমার ভুলটা করলেন হেরাথের বলে বিগ শট খেলে সেঞ্চুরির ইচ্ছা করার কারণে। মিড অফে তার বলটা উঠে গেলে দিলরুয়ান পেরেরা দৌড়ে এসে সেটা তালুবন্দী করলেন। দলকে বাঁচালেও নিজে বাঁচতে পারলেন না। সেঞ্চুরি থেকে ৬ রান দুরে থাকতে সাজঘরে ফিরে গেলেন।
সারাদিনে খুব কষ্টকর হলেও লঙ্কান বোলারদের সাফল্য ছিল মাত্র এই দুটি উইকেট। বাকি সময়টা অনায়াসে পার করে দিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তারা দু’জন মিলে ২৮ রানের জুটি গড়লেও সেটাও ছিল খুব মূল্যবান। কারণ, একটা জুটি ভাঙলে বাংলাদেশের যে উইকেট পড়ার মড়ক লাগে, সেটা হতে দিলেন না অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ এবং মোসাদ্দেক সৈকত। ২৮ রান করে মাহমুদউল্লাহ এবং ৮ রান করে উইকেটে টিকে ছিলেন সৈকত।
লঙ্কান বোলারদের মধ্যে সফল রঙ্গনা হেরাথই বেশি। ৮০ রান দিয়ে যে তিনি নিয়েছেন ২ উইকেট! ১টি করে উইকেট নিলেন ধনঞ্জয়া ডি সিলভা, দিলরুয়ান পেরেরা এবং লক্ষ্মণ সান্দাকান।
এর আগে টেস্টের প্রথম দিন টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিলো ৫১৩ রান। সর্বোচ্চ ১৭৬ রান করেছিলেন মুমিনুল হক। ৯২ রান করে আউট হন মুশফিকুর রহীম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ করেন অপরাজিত ৮৩। তামিম ইকবাল করেছিলেন ৫২ রান। জবাব দিতে নেমে অসাধারণ ব্যাটিং করে শ্রীলঙ্কাও। তারা ৯ উইকেটে ৭১৩ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ১৯৬ রান করেন কুশল মেন্ডিস। ১৭৩ রান করে আউট হন ধনঞ্জয়া ডি সিলভা। ১০৯ রান করেন রোশেনা সিলভা। ৮৭ রান করেন দিনেশ চান্ডিমাল। ৬২ রান করেন নিরোশান ডিকভেলা।
২০০ রান পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৫ উইকেট হারিয়ে করে ৩০৭ রান। ১০৫ রান করে আউট হন মুমিনুল হক। ৯৪ রান করেন লিটন দাস এবং ৪১ রান করেন ইমরুল কায়েস। দুই ইনিংস মিলে ২৮১ রান করার কারণে ম্যাচ সেরার পুরস্কার ওঠে লিটল মাস্টার মুমিনুল হকের হাতে।
এমএমআর/আইআই