বাঁ-হাতি হেরাথকে ঠেকাতে খুব প্রয়োজন ছিল সাকিবের
দিনের শেষ ওভারে মুশফিকুর রহীমকে আউট করে বেশ উল্লাসে মেতে উঠলেন রঙ্গনা হেরাথ আর দিনেশ চান্ডিমালরা। মুশফিক বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান; বিশেষ করে টেস্টে খুব বড় নির্ভরতার প্রতীক। যার দীর্ঘ সময় উইকেটে টিকে থাকার ধৈর্য্য, সামর্থ্য- দুই’ই আছে।
ইতিহাস-পরিসংখ্যান পরিস্কার সাক্ষী দিচ্ছে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম বড় ইনিংসটি মানে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি এই মুশফিকেরই এবং তা লঙ্কানদের বিপক্ষে ও শ্রীলঙ্কার মাটিতেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন এক ব্যাটসম্যানকে চতুর্থ দিন পড়ন্ত বিকেলে সাজঘরে ফিরিয়ে অনেকটাই উৎফুল্ল ও জয়ের আশায় উন্মুখ লঙ্কানরা।
বোলার হেরাথের উচ্ছ্বাসটা বোধ হয় আর সবার চেয়ে বেশি। ভাবছেন তার বলে মুশফিক আউট হয়েছেন তাই? হ্যাঁ, তা অবশ্যই। বাংলাদেশের ব্যাটিং স্তম্ভকে আউট করার বাড়তি উচ্ছ্বাসটা অবশ্যই ছিল হেরাথের; কিন্তু ওই বাঁ-হাতি স্পিনার যেন একটু বেশি উৎফুল্ল। তার চোখে-মুখে একটা অন্যরকম ঝিলিক। মনের গহীনে আগাম সৃষ্টি সুখের উল্লাস। যাক বাবা, মুশফিক হতে পারতো বড় বাধা। প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলার যথেষ্ঠ সামর্থ্যও রাখে। সে ফিরে গেল সাজঘরে।
এখন বাকি শুধু মুমিনুল। কাল তাকে ফেরাতে পারলেই ব্যাস...। ভাবছেন কেন? একা মুুমিনুল কেন? সাথে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, লিটন দাস আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও তো আছে। তারাও তো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান। টেস্টে আহামরি রেকর্ড নেই। তাতে কী, ফার্ষ্ট ক্লাস ক্রিকেটে তো বেশ রান-টান আছে! বড় স্কোরও আছে।
প্রথম শেণির খেলায় লিটন আর মোসাদ্দেক সৈকতের তো ডাবল সেঞ্চুরিও আছে। প্রথম ইনিংসে অবিবেচকের মত রানআউট হয়েছেন, তাতে কি মেহেদি হাসান মিরাজও কিন্তু ব্যাটিং পারেন। কাজেই এখনো বাংলাদেশের ম্যাচ বাঁচানোর মত ব্যাটসম্যান হাতে আছে।
তাহলে রঙ্গনা হেরাথের অত খুশি হবার কি হলো? আছে। হেরাথের খুশি হবার কারণ অন্য জায়গায়। একজন বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে হেরাথ সবার আগে দেখবেন, বাংলাদেশের লাইনআপে আর বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান আছে কজন?
হেরাথের সাথে আপনারাও মিলিয়ে নিন, দুই বাঁ-হাতি তামিম আর ইমরুল আউট। এখন বাঁ-হাতি বলতে বাকি আছেন শুধু মুমিনুল। মাহমুদউল্লাহ, লিটন দাস, মোসাদ্দেক আর মিরাজ সবাই তো ডানহাতি।
একজন বাঁ-হাতি বোলার হিসেবে শেষ দিনের ভাঙ্গা পিচে অতগুলো ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে বল করার সুযোগ মিলবে- তা ভেবেই যে হেরাথ মন আনন্দে আটখানা! এখানেই সাকিব আল হাসানকে মিস করবে টিম বাংলাদেশ।
প্রথম ইনিংসে মুৃমিনুল, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ বেশি ভাল খেলায় হয়ত ব্যাটসম্যান সাকিবের অভাব সেভাবে অনুভুত হয়নি; কিন্তু কাল শেষ দিনে সাকিবকে খুব বেশি করে মনে হবে। কারণ একটাই; সাকিব বাঁ-হাতি। হেরাথের বাঁ-হাতি স্পিন সামলাতে যে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান দরকার বেশি!
প্রথম ইনিংসে বাঁ-হাতি মুমিনুল একাই অনেকটা সময় উইকেটে কাটিয়েছেন। ২১৪ বল খেলেছেন মুমিনুল। অপর দুই বাঁ-হাতি তামিম (৫৩) আর ইমরুলও (৭৫ বল) মিলেও খেলে দিয়েছেন ১২৮ বল। তার মানে তিন বাঁ-হাতি মিলে খেলে ফেলেছেন ৩৪২ বল। যা বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের (১২৯.৫ ওভার) প্রায় ৪৫ ভাগ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই হেরাথের প্রথম ইনিংসে করা ৩৭ ওভারের বড় অংশ তিন বাঁ-হাতি তামিম, ইমরুল আর মুমিনুলের বিপক্ষেই ব্যয় হয়েছে; কিন্তু এবার দ্বিতীয় ইনিংসে হেরাথ পাচ্ছেন এক মুমিনুলকে। কারণ তামিম আর ইমরুল ইতোমধ্যেই সাজঘরে।
একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানই যথেষ্ট এটা বোঝার জন্য। আজ পড়ন্ত বিকেলে হেরাথ ৬.৫ ওভার বল করে ২২ রানে মুশফিকের উইকেটটি নিয়েছেন। অথচ তামিম আর ইমরুল দুই বাঁ-হাতির বিপক্ষে মোটেই সুবিধা করতে পারেননি। ওই সময়ে টানা ৬ ওভারের স্পেলে ছিলেন (২১ রানে) উইকেটশূন্য। প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলে তামিম তাকে মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে স্বাগতঃ জানান। আর হেরাথের তিন নম্বর ওভারে লং অনের ওপর দিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকান ইমরুল।
বোঝাই যাচ্ছে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে হেরাথের কার্যকরিতার সম্ভাবনা অবশ্যই কম; কিন্তু এখনতো বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান বলতে শুধু মুুমিনুল; তাই বার-বার সাকিবের কথা মনে হচ্ছে। সাকিব থাকলে হেরাথের পথটা এত মসৃন থাকতো না। বাঁ-হাতি সাকিব অবশ্যই কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতেন।
এখন যা করার করতে হবে মুমিনুলকে। এই বাঁ-হাতি কাল সকালের সেশনে আউট হয়ে গেলে টাইগারদের ম্যাচ বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে যাবে। একঝাঁক ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বাঁ-হাতি স্পিনার হেরাথ যে আরও আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠতে পারেন!
এটুকু শুনে হয়ত ভাবছেন, ক্রিকেট তো অনিশ্চয়তায় ভরা। বাংলাদেশ চতুর্থ দিন শেষে অবশ্যই ব্যাকফুটে। বেশ চাপে। তাই বলে মাহমুদউল্লাহর দল ম্যাচ বাঁচাতে পারবে না, হেরে যাবে- এমন ভাবাও কিন্তু ঠিক নয়। টাইগারদের ম্যাচ শেষ হয়ে যায়নি এখনো।
আগামীকাল শেষ দিনের পুরো তিন সেশন ক্রিজে কাটিয়ে দিতে পারলেই ম্যাচ ড্র। রোববার পঞ্চম দিনের পুরো সময় উইকেটে পড়ে থাকার দরকার নেই। চা বিরতির পর আর ঘণ্টা খানেক ব্যাট করতে পারলেও চলবে।
তবে কাজটা সহজ নয়। কঠিন। আজ পড়ন্ত বিকেলে তামিম, ইমরুল আর মুশফিকুর রহীম আউট হয়ে ফিরেছেন সাজঘরে। মাহমুদউলল্লাহর দল পিছিয়ে এখনো ১১৯ রানে। আগে এই রানটা অতিক্রম করতে হবে। তারপরও রণে ভঙ্গ দিলে চলবে না। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে অন্তত শেষ ঘণ্টা অবধি। এই কঠিন চ্যালেঞ্জে টাইগারদের পথের কাঁটা হলেন রঙ্গনা হেরাথ।
শেষ দিন হেরাথের বিষাক্ত স্পিন ছোবলেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে টাইগাররা। লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা তাদের কাজ করে দিয়েছেন। ২০০ রানের লিড এসেছে ধনঞ্জয়া ডি সিলভা, কুশল মেন্ডিস, রোশেন সিলভা, অধিনায়ক চান্ডিমাল আর নিরোশান ডিকভেলার চওড়া ব্যাটে।
কিন্তু ম্যাচ জিততে বাংলাদেশকে দুইবার অলআউট করতে হবে লঙ্কানদের। সেই মিশনে লঙ্কানদের আশা ভরসা যে হেরাথ! মুত্তিয়া মুরালিধরন আর চামিন্দা ভাস অবসর নেবার পর টেস্টে শ্রীলঙ্কার বোলিং ট্রাম্পকার্ড এই হেরাথ। উইকেট প্রাপ্তিতে মুরালির (১৩৩ টেস্টে ৮০০ উইকেট) চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকলেও হেরাথ (৮৭ টেস্টে ৪০৬ উইকেট) আগেই চামিন্দা ভাসকে (১১১ টেস্টে ৩৫৫ উইকেট) পিছনে ফেলে উইকেট শিকারে লঙ্কান বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছেন।
এই বাঁ-হাতি স্পিনারের টেস্ট পরিসংখ্যানটা দারুণ সমৃদ্ধ। এক ইনিংসে ৯ উইকেট দখলের রেকর্ডও আছে তার (সেরা বোলিং ৯/১২৭)। ম্যাচে ১৪ উইকেট (১৪/১৮৭) শিকারি এই হেরাথ। ১৯ বার ইনিংসে চার উইকেটের পতন ঘটিয়েছেন। ৫ বা তার বেশি উইকেট পেয়েছেন ৩৩ বার। ম্যাচে ১০ উইকেট শিকারি ৯বার। ইকোনমিটাও দারুণ; মাত্র ২.৮০ করে।
বাংলাদেশের বিপক্ষেও হেরাথের টেস্ট পরিসংখ্যান বেশ সমৃদ্ধ। ৯ টেস্টে ৪৫ উইকেট। একবার ইনিংসে ৭ উইকেট আছে (২০১৩ সালের মার্চে কলম্বোর প্রেমাদাস স্টেডিয়ামে ৩৬-৯-৮৯-৭)। ওই ম্যাচে (৫/৬৮ + ৭/৮৯ = ১২/১৫৭) দু’ ইনিংস মিলে ১২ উইকেট দখল করেছিলেন।
টাইগারদের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত তিন বার ৫ বা তার বেশি উইকেট পাবার রেকর্ড আছে। শেষবার ম্যাচ সেরা (৩/৭২ + ৬/৫৯ = ৯/১৩১) বোলিংটি ঠিক গত বছর মার্চে গলে। সেই ম্যাচে হেরাথের স্পিন ঘূর্ণিতে বেসামাল টাইগাররা হার মানে ২৫৯ রানে।
এর ঠিক পরের টেস্টটি ছিল কলম্বোর পি সারা স্টেডিয়ামে (যেটা বাংলাদেশের শততম টেস্ট)। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতলেও হেরাথ ঠিকই (৪/৮২+৩/৭৫ = ৭/১৫৭) ৭ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে এ টেস্টের প্রথম ইনিংসেও (৩৭-২-১৫০-৩) তিন উইকেট দখল করেছিলেন।
আগামীকাল টাইগারদের ম্যাচ বাঁচানোর চ্যালেঞ্জে তিনিই যে মূল বাধা হয়ে দাঁড়াবেন, তা কি আর নতুন করে বলার দরকার আছে?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম