রাজ্জাকের অভিজ্ঞতা হতে পারতো কার্যকর দাওয়াই
ধনঞ্জয়া ডি সিলভা আর কুশল মেন্ডিসের জুটি ভাঙ্গতে তিন স্পিনার তাইজুল, মিরাজ ও সানজামুলের কম্ম কাবার। ওই দুই লঙ্কানের বিপক্ষে পরিষ্কার বোঝা গেছে, এই ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে খেলা স্পিনাররা নির্বিষ, অকার্যকর। কারো বলে টার্ন নেই। সমীহ আদায় করে লঙ্কানদের চাপে ফেলে একের পর এক উইকেটের পতন ঘটানো বহুদুরের কথা, লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের এতটুকু বিব্রত করে তাদের স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ব্যাট চালনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি কেউ।
এক কথায় তাদের খেলতে কোন লঙ্কান ব্যাটসম্যানের কোনই সমস্যা হয়নি। আর তাই বার বার মনে হয়েছে সাকিব আল হাসানের কথা। স্পিনার সাকিব যে আসলে দলের কত বড় সম্পদ, তা বোঝা গেছে এ ম্যাচেই।
একটা কঠিন সত্যও ফুটে উঠেছে- তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ ও মুমিনুলরা ব্যাটসম্যান সাকিবের অভাব কমাতে পারেন; কিন্তু বোলার সাকিবের জায়গা নেবার নেই কেউ। তার জায়গা পূরণ অসম্ভব। তার অনুপস্থিতিতে কেউ যে স্পিন ডিপার্টমেন্টকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন, এ মুহূর্তে সেই মানের কেউ নেই দলে।
মিরাজ, তাইজুলরা সহায়ক ভুমিকা নিতে পারেন; কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র নেবার সামর্থ্য হয়নি এখনো কারও। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, কেন মিরাজ তো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্টে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। ইংলিশদের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের নায়কও হয়েছেন তিনি। অভিষেকে ইংলিশদের বিপক্ষে টেস্ট জেতানোর রেকর্ডও গড়েছেন।
তা করেছেন অবশ্যই। প্রথম কথা, সেটা ছিল শতভাগ স্পিন সহায়ক উইকেটে। যে পিচ ছিল বোলারদের মানে স্পিনারদের স্বর্গ। বল পড়ে লাটিমের মত ঘুরেছে। ব্যাটসম্যানদের বুঝতে আর খেলতে নাভিশ্বাস উঠেছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, সেই পিচে কিন্তু মিরাজের সঙ্গী ছিলেন সাকিব আল হাসান। ভুলে গেলে চলবেনা- মিরাজের সে বিষমাখা স্পিন বোলিং কিন্তু সাকিবের সাথে থেকেই। তারই ছায়ায়। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে স্পিনারদের সাফল্যের মিশনের নেতৃত্বটা কিন্তু সাকিবই দিয়েছেন।
একদিকে সাকিব ইংলিশ ও অজি ব্যাটসম্যানদের চাপে রেখেছেন। প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন। সাকিব মহিরুহ হয়ে থাকায় মিরাজ ও তাইজুলদের বড় বৃক্ষ মনে হয়েছে। সাকিব থাকায় মিরাজ ও তাইজুলদের যতটা বড় বোলার মনে হয়েছে, তাদের বলে যে ধার পরিলক্ষিত হয়েছে- এখন তার ছিটেফোটাও নেই।
এখনো ম্যাচ জেতানো বোলার হওয়া বহুদুরে, সাকিব না থাকলে যে মিরাজ ও তাইজুলরা এখনো প্রতিপক্ষ ব্যাটিংয়ে ভয় ধরাতেই পারেন না- জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার এ টেস্ট তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
কেউ কেউ হয়ত উইকেটের ধোয়া তুলবেন, বলবেন- আরে পিচতো ব্যাটিং স্বর্গ। এখানে তাইজুল, মিরাজ ও সানজামুলরা কি করবেন? তাদের জন্য বলা, প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ যখন ব্যাট করেছে, তখনো তো পিচ এমনই ছিল; কিন্তু তার মধ্যেও বাঁ-হাতি রঙ্গনা হেরাথ ঠিক ভাইটাল ব্রেক থ্রু উপহার দিয়েছেন।
৩১ জানুয়ারি টেস্টের প্রথম দিন কোন উইকেট না পেলেও পরদিন সকাল-সকাল মুমিনুলকে ফেরানো সহ ৩৭ ওভারে ১৫০ রানে তিন উইকেটের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের মিডল অর্ডারে ভাঙ্গন ধরিয়েছেন। আরেক স্পিনার ল² সান্দাকানও খারাপ করেননি। দুই বাঁ-হাতি ইমরুল কায়েস ও সানজামুলের উইকেট জমা পড়েছে স্লো লেফট আর্ম চায়নাম্যান সান্দাকানের পকেটে।
হেরাথ ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখা মুমিনুলকে ফিরিয়ে বাংলাদেশ ইনিংসের ছন্দপতন ঘটিয়েছেন; কিন্তু দুই বাঁ-হাতি তাইজুল-সানজামুল আর অফ স্পিনার মিরাজ তার কিছুই করতে পারেননি। উইকেটে যখন টার্ন কম, তখন মূল কাজ হলো মাপা লাইন ও লেন্থে যতটা সম্ভব বুদ্ধি খাটিয়ে বল ফেলা। বাড়তি কিছু করার চেষ্টায় না গিয়ে উইকেট সোজা ডেলিভারি দিয়ে ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখার কাজে মন দেয়া। যাতে ব্যাটসম্যান স্বচ্ছন্দে শটস খেলতে না পেরে এক সময় ভুল করেই উইকট দিয়ে আসবে।
এ চিরন্তন ফর্মুলাও অনুস্মরণ করতে পারেননি বাংলাদেশের কোন স্পিনার। তারা হয়ত ধরেই নিয়েছিলেন আমাদের আর আঙ্গুল, হাত-কব্জির মোচড়ে বল ঘোরাতে হবে না- বল পিচে পড়ে আগের মত টার্ন করবে; কিন্তু বাস্তবে যখন তা হচ্ছে না, তখনই তাইজুল, মিরাজ ও সানজামুলরা পড়ে গেছেন বিপাকে। এমন উইকেটে আসলে করণীয় কি? তাও মনে হয় ঠাউরে উঠতে পারছেন না তারা। তাইতো তিনজনে মিলে ১০৭ ওভার বল করেও ব্যর্থ।
এখানেই বাড়তি মেধা আর অভিজ্ঞতায় ঘাটতি সুস্পষ্ট। এসব উইকেটে কোন লাইন ও লেন্থে বল ফেললে ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখা যায়, তার স্বাভাবিক ছন্দ বিঘিœত হয় এবং তিনি এক সময় বিরক্ত হয়ে এলোমেলো শট খেলতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসবেন- এসব জানতেও অভিজ্ঞতার দরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ টেস্টে যে তিনজন খেলছেন তাদের তাতে পরিষ্কার ঘাটতি আছে।
তাই উইকেটের সাহায্য না পেয়ে বিকল্প পথে হাঁটার কৌশলও তাদের যেন অজানা। এখানেই সাকিব থাকলে ঠিক বিকল্প পথ খুঁজে বের করতেন। তার দেখা-দেখি তাইজুল-সানজামুলও পিছনে হাঁটতে পারতেন; কিন্তু এখন পথ দেখানোর যে কেউ নেই! তাইতো ৫০০+ রানের বিশাল স্কোর গড়েও লিড নেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের।
সাকিব আল হাসানের মত বিশ্বমানের এক স্পিনারের অভাববোধ হয়ত এই ম্যাচে একটু হলেও কমে যেত, যদি অভিজ্ঞ আব্দুর রাজ্জাককে খেলানো হতো। ধরে নেয়াই যায় প্রায় ৩৭ বছর বয়সী রাজ্জাক সোনালী সময় পিছনে ফেলে এসেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটিং স্বর্গে প্রতিপক্ষর আনকোরা ব্যাটসম্যানদের ঘোলপানি খাইয়ে এখনো জাতীয় লিগ ও বিসিএলে ৪, ৫, ৬ উইকেটের পতন ঘটাচ্ছেন।
হয়ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশেষ করে টেসেট তার বলের ধার কমে গেছে অনেক; কিন্তু অভিজ্ঞতা তো আর শেষ হয়ে যায়নি। ম্যাচের এখন যে পরিস্থিতি, তাতে কিভাবে বোলিং করলে লাভ হতো, তা ভালই জানা রাজ্জাকের। এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা হতে পারে সর্বোত্তম অস্ত্র। সে অভিজ্ঞতার ভান্ডার যে রাজ্জাকেরই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ! এই ম্যাচে তা কাজে লাগানো যেত; কিন্তু তিনি তো একাদশেই নেই!
অনেকে হয়ত বলবেন রাজ্জাক তো মূলতঃ ওয়ানডে বোলার। তার টেস্ট রেকর্ড তো সাকিবের ধারে কাছেও না। তিনি কি করে টেস্টে সাকিবের বিকল্প হন? তা ঠিক আছে। পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরলে টেস্টে রাজ্জাক যোজন-যোজন পিছিয়ে। সাকিব যেখানে ৫১ টেস্টে ১৮৮ উইকেট শিকারি, সেখানে মাত্র ১২ টেস্টে রাজ্জাকের উইকেট মোটে ২৩টি। একবারের জন্য ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ডও নেই তার।
তাই ধরে নেয়া যায় সাকিবের ৪/৫ উইকেটের পতন ঘটাতে না পারলেও অন্তত গোটা দুয়েক উইকেট ঠিকই পেতেন রাজ্জাক। বাকিদের মত এমন ব্যর্থতার ঘানি টানতে হতো না হয়ত। কত উইকেট পেতেন? তা নিয়ে সংশয় থাকলেও রাজ্জাকের দীর্ঘ প্রথম শ্রেণির অভিজ্ঞতা হতে পারতো অনেক বেশি সহায়ক উপাদান। দেশের হয়ে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অনেক বেশি সফল রাজ্জাক টেস্টে আহামরি রেকর্ড না থাকলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন যে কোন স্পিনারের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের একমাত্র বোলার হিসেবে প্রথম শেণির ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট শিকারের দূর্লভ কৃতিত্বটাও রাজ্জাকের।
টেস্ট হয়ত বেশি খেলেননি; কিন্তু জাতীয় লিগ ও বিসিএলে চট্টগ্রমের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খেলেছেন অনেকবার। এই মাঠে তার চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের কোন বোলারের। সাকিব যেহেতু নেই, তাই এ টেস্টে তাইজুল ও মিরাজের গাইড হতে পারতেন রাজ্জাক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বেশি খেলার কারণে কখন কি করতে হয়? কোন উইকেটে কোন লাইন ও লেন্থ বেশি কার্যকর? উইকেটে ব্যাটসম্যান সেট হয়ে গেলে তার মনোযোগ-মনোসংযোগ কিভাবে ভাঙ্গতে হয়, তাকে ভুলের ফাঁদে কিভাবে ফেলা যায়- এসব রাজ্জাক নিশ্চয়ই অনেক ভাল জানতেন, বুঝতেন।
সুতরাং, আরেক বাঁ-হাতি সানজামুলকে বাইরে রেখে রাজ্জাককে খেলানো হলে নিশ্চিত বাংলাদেশের স্পিন ডিপার্টমেন্ট হতো সমৃদ্ধ। শেষ কথা, যে পিচে বল ঘোরে না, যে ট্র্যাকে ব্যাটসম্যানকে স্পিনে পরাস্ত করা সম্ভব হয় কম- সেখানে অভিজ্ঞতাই বড় অস্ত্র।
তখন বোলারের ব্যক্তিগত দক্ষতা, মুন্সিয়ানা এবং বল ঘোরানোর সামর্থ্য ছাপিয়ে অভিজ্ঞতাই হয়ে ওঠে বড় অস্ত্র। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে লঙ্কানদেও বিপক্ষে এ টেস্টে রাজ্জাক থাকলে সেই অভিজ্ঞতার বড় অস্ত্রটা ব্যবহার করা যেত; কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট আর নির্বাচকদের অদুরদর্শিতায় সে ‘অভিজ্ঞতার অস্ত্রটি’ যে অবব্যহৃতই থেকে গেল!
এআরবি/আইএইচএস/পিআর