হাথুরুর অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছে শ্রীলঙ্কা!
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ বলেছিলেন, তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে থাকার পরও তারা খুব রিল্যাক্সড। এরপর দিনেশ চান্দিমাল বলেছিলেন, হাথুরু তাদের সম্পদ। স্বদেশি কোচ, তার ওপর হাথুরুসিংহের ওপরও বিশাল চাপ। শ্রীলঙ্কা দলের দুই সিনিয়র ক্রিকেটার তাদের কোচকে পাশে রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক।
তবে সিরিজ শুরুর আগে থেকে একটা শঙ্কা খুব কাজ করছিল, সেটা বাংলাদেশের জন্য। সেটা ছিল হাথুরু ফ্যাক্ট। হাথুরুই বাংলাদেশের প্রধান প্রতিপক্ষ। তিনি জানেন বাংলাদেশের শক্তি ও দুর্বলতা। তার কাছেই না আবার হারে বাংলাদেশ!
সিরিজের প্রথম ম্যাচে হাথুরুর এই ফ্যাক্ট বুঝতে দেয়নি বাংলাদেশের টপ অর্ডাররা। সাকিব, তামিম, বিজয় কিংবা মুশফিকদের দারুণ ব্যাটিংয়ে ৩২০ রান করার পর ১৬৩ রানে লঙ্কানদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচের পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়, হাথুরুকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু বাংলাদেশের কোচ-খেলোয়াড়দের সবাই একই সুরে বলছিলেন, খেলাটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। হাথুরুর বিপক্ষে নয়। তিনি পেশাদার। পেশাদারিত্বের কারণে আজ এখানে তো কাল ওখানে থাকবেনই। এটা বড় কোনো বিষয় নয়।
কিন্তু হাথুরু ফ্যাক্টটা এবার ঠিকই বোঝা গেলো। সিরিজে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে উড়তে থাকা বাংলাদেশকে বলতে গেলে টেনে নামিয়েছে শ্রীলঙ্কা। মাত্র ৮২ রানে অলআউট করে দিয়ে ১১.৫ ওভারে ১০ উইকেটেই জয় তুলে নিলো তারা। বল হাতে রাখল আরও ২২৯টি। অনেক বড় লজ্জাই বলতে গেলে বাংলাদেশের জন্য। দিবা-রাত্রির ম্যাচে মিরপুর স্টেডিয়ামের ফ্ল্যাড লাইটই প্রজ্জলনের প্রয়োজন হলো না। ৫০+৫০ = ১০০ ওভারের পুরো ম্যাচটা শেষ হয়ে গেলো সর্বমোট ৩৫.৫ ওভারে।
হাথুরু যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা জানেন এবং সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন, সেটা এই ম্যাচেই বোঝা গেলো। এনামুল হক বিজয়ের ওপর চাপ ছিল স্টাইক রেট বাড়ানোর। নিজের স্বভাবজাত ব্যাটিংটা তিনি করতে পারছিলেন না। কিছুটা স্লো ধরনের- এ কারণে দীর্ঘদিন ছিলেন দলের বাইরে।
এবার দলে আসলেন, অলিখিত শর্তও ছিল, রান যাই করুক স্ট্রাইক রেটটা যেন বেশি থাকে। মোট কথা, ব্যাটিং অ্যাপ্রোচটা যেন আরও অনেক বেশি ইতিবাচক হয়। সে চাপেই চ্যাপ্টা বিজয়। আগের ম্যাচে ১ রানের পর এই ম্যাচে আউট হলেন কোনো রান না করেই। বরং, পুরোপুরি বোকামি করে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে বলটাকে টেনে আনলেন স্ট্যাম্পে।
সাকিব আল হাসানের দুর্ভাগ্য। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ঠেলে দিয়েই দ্রুত এক রান নিতে গিয়ে ফিল্ডার গুনাথিলাকার সরাসরি থ্রোতে ভাঙলো স্ট্যাম্প। সাকিব হয়ে গেলেন রানআউট। লঙ্কানদের ভাগ্যটাও যেন খুব বেশি ভালো ছিল আজ। তার ওপর কোন ব্যাটসম্যানকে কোন জায়গায় বল দিলে তিনি পরাস্ত হবেন, এই শিক্ষাটা এতদিন পর শিষ্যদের গলাধঃকরণ করাতে পারলেন হাথুরুসিংহে।
সুরঙ্গা লাকমালের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দিলেন। অনেক দূর দৌঁড়ে গিয়ে দানুসকা গুনাথিলাকা ঝাঁপিয়ে পড়ে তামিমের ক্যাচটি নিলেন। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কোমর যেন তখনই ভেঙে দিলেন লঙ্কান এই ফিল্ডার। সাকিবকে সরাসরি থ্রোতে রানআউট করার পর অসাধারণ ক্যাচ নিলেন তামিমের। এই সাকিব-তামিমই তো চলতি সিরিজে বাংলাদেশের সেরা পারফরমার।
খেলোয়াড়দের প্রতি হাথুরুর বিশেষ প্রেসক্রিপশন ছিল এই দু’জনকে নিয়েই। গুরুর শিক্ষা পুরোপুরি হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন লাকমাল আর গুনাথিলাকা। লাকমালের বোলিং আর গুনাথিলাকার ফিল্ডিং দেখে লঙ্কানদের সোনালি সময়ের কথাই হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল কারও কারও। সোনালি সময়ে তো এভাবেই বোলিং আর ফিল্ডিং করতো ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপজয়ীরা।
পরের ব্যাটসম্যানদের জন্য খুব সিম্পল প্ল্যানিং। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে শরীর বরাবর বাউন্স দিলেন। এর গালি এবং ফাইন লেগের মাঝে একজন ফিল্ডার রেখে দিলেন চান্দিমাল। পরিকল্পনা মতোই বল দিলেন লাকমাল। ক্যাচ তুলে দিলেন মাহমুদউল্লাহ। গালি এবং ফাইন লেগে দাঁড়ানো দুষ্মন্তে সামিরার হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন তিনি। মিডল অর্ডারের কোমরও ভেঙে গেলো এর সঙ্গে সঙ্গে।
সাব্বির রহমান, আবুল হাসান রাজু কিংবা নাসির হোসেনরা যে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখেন না, সেটা তো আর সবার চেয়ে ভালো জানা হাথুরুর। সুতরাং, তার কাটা ছকেই একে একে সাব্বির, রাজু আর নাসিরকে তুলে নিলো লঙ্কান বোলাররা। মুশফিকুর রহীম কিছুটা প্রতিরোধ গড়েছিলেন; কিন্তু সেটা কতক্ষণ! আবুল হাসান রাজু ব্যাটের কানায় লাগিয়ে উইকেট রক্ষকের হাতে ক্যাচ দেয়ার পর মুশফিকও বোকার মত উইকেট দিয়ে এলেন।
দুষ্মন্তে সামিরার অফ কাটার বলে কাট করতে গিয়েছিলেন মুশফিক। একেবারেই বোকার মত ব্যাটিং করলেন। বল চলে গেলো কুশল মেন্ডিসের হাতে। সর্বোচ্চ ২৬ রানের ইনিংসটিরও পরিসমাপ্তি ঘটলো। এরপর মাশরাফি-রুবেলদের পরিকল্পনামত তুলে নিতে কোনোই বেগ পেতে হলো না লঙ্কান বোলারদের। ৮৩ রানের লক্ষ্য তো হেসে খেলেই পার করে দিল গুনাথিলাকা আর থারাঙ্গারা।
গত ডিসেম্বরে ডুবতে থাকা লঙ্কান দলটির দায়িত্ব নেয়ার পর তাদেরকে গুছিয়ে তুলতে হাথুরুর সময় লাগবেই এটা স্বাভাবিক। অন্য যে কোনো দলের বিপক্ষে তার কৌশল যেমনই হোক, বাংলাদেশের বিপক্ষে সাজানো কৌশলটা যে অন্য যে কারোর চেয়ে নিখুঁত এবং কার্যকর হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোচের বার্তা, হয়তো প্রথম ম্যাচে শিক্ষাটা ধরতে পারেনি তার শিষ্যরা। অবশেষে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঠিকই শিক্ষাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারলো চান্দিমাল, লাকমাল, থারাঙ্গারা।
ফাইনালে কী হবে? হাথুরুর পরিকল্পনা নিশ্চিত বাংলাদেশের বিপক্ষে আরও নিখুঁত হবে। ব্যাটসম্যান এবং বোলাররা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে যতটা সতর্ক হতে পারবে, ততটাই মঙ্গল হবে টিম বাংলাদেশের জন্য।
আইএইচএস/এমএমআর/জেআইএম