‘ব্যাটিং’য়েই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি
ক্রিকেটে একটি বড় দল হয়ে ওঠার লক্ষ্মণগুলো কী কী! এ নিয়ে হয়তো বিস্তার চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এক সময় আমরা দেখতাম, বড়দলগুলো ছোটদের অনায়াসে হারিয়ে দেয়। বিপদের মুহূর্তেও তারা ধৈয্য হারা হয় না। দলের বেশ কয়েকজন নিয়মিত পারফর্ম করে যান। এরপর প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হেসে-খেলে জয় নিয়ে ঘরে ফেরে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ অন্য সব বড়দলের সামনেই নিজেদেরকে আতঙ্ক হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছে। কেউ আর স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নামতে পারে না। বাংলাদেশ দলের প্রতিটি সদস্য, প্রতিটি দিক নিয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে তবেই তারা পরিকল্পনা সাজায় এবং মাঠে খেলতে নামে। তাতেও যদি কাজ হতো! ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে গত বছর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি- সব জায়গাতেই সেটার স্বাক্ষর রেখেছে টিম বাংলাদেশ।
যে জিম্বাবুয়ে এক সময় ছিল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সময়ের ব্যবধানে তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের তুলে এনেছিল টাইগাররা। এখন বাংলাদেশের সামনে জিম্বাবুয়ে অনেকটাই ‘ছোট’ দল। হেসে-খেলে তাদেরকে হারায় মাশরাফি বাহিনী। জিম্বাবুয়ের পর ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে নিউজিল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকাকেও খাবি খেতে হয়। পাকিস্তানও তো হোয়াইটওয়াশ হলো চলতি সিরিজে। কিন্তু নিজেদের মাঠে সেই নিউজিল্যান্ডকে বলে-কয়ে হারাতে পারে টাইগাররা। শুধু তাই নয়, বিদেশের মাটিতেও নিউজিল্যান্ডকে একাধিকবার হারানোর অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে টাইগারদের। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে ত্রিদেশীয় সিরিজে একবার এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একবার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল মাশরাফি অ্যান্ড কোং।
শ্রীলঙ্কাও যুক্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর তালিকায়। তাদের ঘরের মাঠে হারিয়ে আসার অভিজ্ঞতা হয়েছে টাইগারদের। নিজেদের মাঠে সেই শ্রীলঙ্কাকে পেয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করতে শুরু করেছে, সত্যি সত্যি বড় দল হয়ে উঠছে তারা। অন্তত ৫০ ওভারের ক্রিকেটে।
ত্রিদেশীয় সিরিজ শুরুর আগে থেকেই তুমুল আলোচনার বিষয়, হাথুরু সদ্য বাংলাদেশের কোচ ছিলেন। টাইগারদের দায়িত্ব ছেড়ে তিনি চলে গেলেন নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায়। সেই হাথুরু তো বাংলাদেশের হাঁড়ির খবর সব জানেন। সুতরাং, ত্রিদেশীয় সিরিজে তো তিনি এবং তার দলই এগিয়ে থাকবে। কেউ কেউ তো শ্রীলঙ্কা নয়, বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে হাথুরুসিংহেকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু নিয়মিতই ওয়ানডে ক্রিকেটে পারফর্ম করা বাংলাদেশ এসব ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় কখনোই যেতে নারাজ। অধিনায়ক মাশরাফি থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব ক্রিকেটারই বলে দিয়েছেন, হাথুরুর বিষয়টা আমরা মাথায়ই নিচ্ছি না। এ নিয়ে চিন্তাও করতে চাই না। আমাদের চিন্তায় শুধুই শ্রীলঙ্কা এবং তাদের বিপক্ষে আমাদের ভালো করার চিন্তা।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে যখন তুমুল স্নায়ুচাপ বিরাজ করছিল, তেমনই এক ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ লঙ্কানদের সামনে ৩২০ রানের বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। রান করেছেন দুই ওপেনার তামিম, এনামুল, ওয়ানডাউনে নামা সাকিব এবং টু-ডাউনে (চার নম্বরে) নামা মুশফিকুর রহীম। টপ অর্ডারের দারুণ এই ধারাবাহিকতা, নিশ্চিত হাথুরুসিংহে চিন্তাই করতে পারেননি। ফলে বাংলাদেশও একটা হ্যান্ডসাম স্কোর দাঁড় করিয়ে দিলো লঙ্কানদের সামনে।
টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ৮৪ রানের ইনিংস খেললেন তামিম ইকবাল। আগের মাচেও খেলেছিলেন ৮৪ রানের ইনিংস। যদিও ওই ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন তামিম। লঙ্কানদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার সুযোগ ছিল; কিন্তু আকিলা ধনঞ্জয়ার বলে উইকেটের পেছনে ডিকভেলার হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তামিম। এনামুল হক বিজয়ও ওপেনিংয়ে সূচনাটা দারুণ করে দিয়ে যান। ৭১ রানের জুটি গড়ে তিনি বিদায় নেন ৩৫ রান করে। অনেকদিন পর যেন ওপেনিংয়ে প্রাণ ফিরছে বাংলাদেশ দলে।
সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল মিলে গড়েন ৯৯ রানের দারুণ এক জুটি। তামিম আউট হওয়ার পর সাকিব আর মুশফিক মিলে গড়েন ৫৭ রানের জুটি। ৬৭ রান করেন ওয়ানডাউনে নামা সাকিব। নিজে থেকে তিন নম্বরে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত সাকিবের বেশ ফলপ্রসুই হচ্ছে মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিজেকে এই পজিশনে সেট করে নিচ্ছেন তিনি। আজ একটু বোকামি না করলে হয়তো ইনিংসটা আরও বড় করতে পারতেন তিনি।
আগের তিনজনের দেখানো পথে স্বাচ্ছন্দে হেঁটেছেন মুশফিকুর রহীমও। টেস্ট অধিনায়কত্ব হারিয়ে একট ধরনের মানসিক চাপে থাকা মুশফিকের জন্য এই ইনিংসগুলো হবে দারুণ কার্যকর। লঙ্কানদের বিপক্ষে যেমন খেললেন ৬২ রানের ইনিংস। বল খেলেছেন ৫২টি। ব্যাটিং লাইনে নিচের ব্যাটসম্যানরাও দারুণ অবদান রেখেছেন। মাহমুদউল্লাহ এবং সাব্বির রহমান খেলেচন সমান ২৪ রানের ইনিংস। সাব্বির তো শেষ ওভারে একাই নিয়েছেন ১৮ রান।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ছিল দারুণ পরিকল্পনার চাপ। দুই ওপেনারের সতর্ক-সাবধানি সূচনা, দু’তিনটি দারুণ জুটি এবং শেষ পর্যন্ত শেষ দিকে এসে হার্ড হিটিং- সত্যি সত্যি বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বোলিংয়ের কথা না হয় নাই বলা হলো। জিম্বাবুয়ে উড়ে গিয়েছে বোলারদের সামনে। ৩২০ রানের নিচে চাপা পড়ার পর বাংলাদেশের বোলারদেরও তোপের মুখোমুখি হলো হাথুরুসিংহের শ্রীলঙ্কা।
আইএইচএস/পিআর