১৫ বছর পর সেই ঘরের মাঠে নতুন যাত্রা শুরু সুজনের!
খালেদ মাহমুদ সুজন-ক্রিকেট পাড়ায় তার আরও দুটি নাম বা বিশেষণ আছে। এক 'চাচা'। দুই 'ফাইটার'। প্রথমটি ক্রিকেট সম্পৃক্ত সবার সাথে আন্তরিক ও নিবিড় সম্পর্কের কারণে। আর পরেরটি মাঠে লড়াকু মানসিকতার কারণে।
সেই লড়াকু খালেদ মাহমুদ সুজন আজ হঠাৎ আবেগ আপ্লুত। টিম বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম থেকে শেরে বাংলার কনফারেন্স হল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় খানিক আনমনা মনে হলো তাকে। পাশেই হেঁটে আসা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা খানিক বিনম্র মুখায়বে হাঁটলেন। আর খালেদ মাহমুদ সুজনকে দেখে মনে হলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।
আসলে খালেদ মাহমুদ সুজন ইতিহাসের আয়নায় দাঁড়িয়ে পিছনের সুজনকে খুঁজে ফিরছিলেন। তিনি নিজেকে খুঁজে ফিরতেই পারেন। সত্যিই এবারের ত্রিদেশীয় ক্রিকেট সিরিজ যে তার নতুন করে ফিরে আসা।
কি অদ্ভূত মিল! ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে টিভিএস কাপ নামক এক তিন জাতি আসর দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। ১৫ বছর আগে ঘরের মাঠে এমন এক ত্রিদেশীয় আসরে অধিনায়কের অভিষেক হওয়া সুজন এবার দেশের মাটিতে আরেক তিন জাতি টুর্নামেন্টে প্রথমবার কোচ!
খালেদ মাহমুদ সুজন কোচ? একটু কি খটকা লাগছে? কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, জাগো নিউজে এত বড় ভুল তথ্য লিখা হলো কি করে! সুজন তো আর হেড কোচ নন, তিনি তো টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। তার জন্য এটা অনেক বড় কিছু। সুজনের জন্য এ তিন জাতি আসর তাৎপর্যপূর্নই বা কেন? এ তিন জাতি ক্রিকেট আসর তার জন্য চ্যালেঞ্জিংই বা কি কারণে ? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
হ্যাঁ এটা সত্যি, হাথুরুসিংহে যেমন এখন শ্রীলঙ্কার হেড কোচ। হিথ স্ট্রিাকের কাঁধে যেমন জিম্বাবুয়ে দল পরিচালনার দায় দায়িত্ব। খালেদ মাহমুদ সুজন তেমন নন। তিনি তো আর হেড কোচ নন। তিনি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর।
এটা আসলে পদবি। তাকে হেড কোচ করা হয়নি। বরং হাথুরুর প্রধান সহকারি রিচার্ড হ্যালসলকেই তিন জাতি ক্রিকেটে কোচিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেটা অফিসিয়ালি। আর খালেদ মাহমুদ সুজনকে করা হয়েছে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর।
ভিতরের খবর অন্য। টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের তকমা গায়ে আঁটা থাকলেও আসলে টিম বাংলাদেশের কোচ বা দৌনাচার্য্য যাই বলা হোক না কেন, সেটা খালেদ মাহমুদ সুজন। পরিচয় ও পদবি ভিন্ন। কিন্তু বিসিবি তার হাতেই দল পরিচালনা, পরিচর্যা ও তত্ত্বাবধানের দায় দায়িত্ব অর্পন করেছে। অর্থাৎ তিন জাতি আসরে তিনিই হাথুরুর বিকল্প।
এ আসর তাই খালেদ মাহমুদ সুজনের জন্য এক অন্যরকম টুর্নামেন্ট। তার দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জানার পর যে কেউ খালি চোখে ভাববেন, এটাই বুঝি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ও অ্যাসাইনমেন্ট। আসলে তা নয়।
ইতিহাস জানাচ্ছে, খালেদ মাহমুদ সুজন এর আগেও বড় দায়িত্ব পালন করছেন। ভাববেন না জাতীয় দলের ম্যানেজার হবার কথা বুঝি বলা হচ্ছে। ভুলে যাবেন না সুজন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কও। তাও এক কঠিন সময়ে। এক কথায় ‘ক্রান্তিলগ্নে।’
ক্রান্তিলগ্ন শুনে আবার বাড়াবাড়ি মনে করবেন না। ইতিহাস ঘটালেই দেখবেন, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে চরম ভরাডুবি ঘটেছিল বাংলাদেশের। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে স্কটল্যান্ডের মাটিতে স্কটিশদের হারানোর পাশাপাশি ওয়াসিম আকরাম, সাইদ আনোয়ার, শহিদ আফ্রিদী, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম উল হক, সেলিম মালিক, আজহার মেহমুদ, ওয়াকার ইউনুস, সাকলাইন মুশতাক আর শোয়েব আখতারদের নিয়ে গড়া পাকিস্তানের সে সময়ের দুর্দমনীয় প্রায় দলকে মাটিতে নামিয়ে আনা বাংলাদেশ ঠিক চার বছর পর ২০০৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং দারুনভাবে নাজেহাল হয়। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ধুঁয়ে মুছে যায়। এছাড়া বাকি সব ম্যাচ হেরে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে খালেদ মাসুদ পাইলটের দল।
দুই পাকিস্তানি মহসিন কামাল আর আলী জিয়ার মত অদক্ষ, অদূরদর্শি এবং স্বল্প ক্রিকেট বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন কোচের অধীনে খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতত্বে ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ শুধু যে ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর কাছে হার মানে, তা নয়। আইসিসির দুই সহযোগি সদস্য কানাডা আর কেনিয়ার সাথেও পারেনি। লজ্জাজনকভাবে হেরে বসে।
তারপর পরই শুরু হয় শুদ্ধ অভিযান। অযোগ্য দুই পাকিস্তানী কোচ মহসিন কামাল আর আলী জিয়াকে পদচ্যুত করা হয়। অধিনায়কত্ব হারান খালেদ মাসুদ পাইলটও। ২০০৩ সালের ১ মার্চ কেনিয়ার কাছে ওই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে ৩২ রানের হারের এক মাস পর ঘরের মাঠে বসেছিল তিন জাতি ক্রিকেট আসর ‘টিভিএস কাপ’। সেখানেই খালেদ মাসুদ পাইলটের বদলে অধিনায়ক হলেন খালেদ মাহমুদ সুজন।
একটা ভাঙ্গাচোরা দলকে নতুন করে গড়ে তোলা ও সামনে এগিয়ে নেবার গুরু দায়িত্ব কাঁধে বর্তালো 'চাচা' ও 'ফাইটার' সুজনের কাঁধে।
জানেন ওই আসরে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কে কে ছিল? একদিকে ভারত আর অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা। একই আসরে অধিনায়কত্বের অভিষেক হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথেরও। ঠিক ওই আসরে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলেও ধীরে ধীরে দলের সম্প্রীতি, ঐক্য-সংহতি এবং শৃঙ্খলা এসেছিল ফিরে। মাঠে ভাল খেলার তাগিদ , সংকল্পও হয়েছিল দ্বিগুণ।
তাইতো ওই তিন জাতি আসরের কয়েক মাস পর পাকিস্তান সফরে খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে পাকিস্তানের তখনকার দুর্দান্ত শক্তিশালি দলকে প্রায় টেস্টে হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। পরে আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভার দুর্বল খেলা পরিচালনা আর ইনজমাম উল হকের অতি মানবীয় ব্যাটিংয়ে অল্পের জন্য জয় হয়েছিল হাতছাড়া। ধীরে ধীরে সংকট ও বিপর্যয় কাটিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল সুসংগঠিত।
সেই সুজন এবার হেড কোচ হাথুরুসিংহের অনুপস্থিতিতে কোচের ভূমিকায়। দেখা যাক, নতুন ভুমিকায় কেমন করেন তিনি?
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম