আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট : গেইল
জাতীয় দলের জার্সি গায়ের হিসাবটাই শুধু ভিন্ন। সেখানেও ক্রিস গেইল রাজা। তবে সম্রাট নন। কারণ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক ক্রিস গেইল নন; ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। এ ব্ল্যাক ক্যাপস ব্যাটসম্যান নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৭১ ম্যাচে ৭০ ইনিংসে দুই হাজার ১৪০ রান করে বসে টপ স্কোরারের আসনে।
কিন্তু এর বাইরে আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল, এসএলপিএল কিংবা পিএসএলসহ বিশ্বে যত টি-টোয়েন্টি আসর আছে তার পুরো সাম্রাজ্যই গেইলের। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি (৩২০ ম্যাচে ৩১৪ ইনিংসে ব্যাট করে ১১ হাজার ৫৬) রান, সর্বাধিক (২০ সেঞ্চুরি), হাফ সেঞ্চুরি (৬৭), এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান (১৭৫) এবং সবচেয়ে বেশি ছক্কার (৮১৯টি) মালিক গেইল। এক কথায় তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সম্রাট। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটের রাজাধিরাজ।
এতগুলো কৃতিত্ব যার একার, তিনি নিজেকে কী ভাবেন? নিজের সম্পর্কে তার মূল্যায়নটাই বা কী? তাহলে শুনুন, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ভয়ঙ্করতম ও বিস্ফোরক উইলোবাজ নিজেকে এই ফরম্যাটে সবচেয়ে সেরা ব্যাটসম্যান ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন।
মঙ্গলবার রাতে ফাইনাল শেষে সংবাদ সম্মেলনে গেইলের কাছে প্রশ্ন উঠলো, এই ফরম্যাটের পুরো রাজত্বটাই আপনার। একজন ব্যাটসম্যানের যতগুলো কৃতিত্ব থাকতে পারে, তার প্রায় সবগুলোই আপনার একার।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আপনি নিজেকে কী ভাবেন, কোথায় রাখেন? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে খানিক রসিকতার ছলে হলেও গেইল বলে ওঠেন, ‘ইয়া...! আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অব অলটাইম।’
গেইল নিজেকে টি-টোয়েন্টির সেরা ব্যাটসম্যান ভাবতেই পারেন। তার ব্যাটের ঝলকানি আগেও দেখেছেন বাংলাদেশের দর্শকরা। এই শেরে বাংলায় আগে এবং এবার মিলিয়ে বিপিএলের প্রতি আসরে অংশ নেয়া গেইল সর্বাধিক পাঁচ-পাঁচটি শতরান হাঁকিয়েছেন।
তবে আজকের শতরানটি অন্য সেঞ্চুরিগুলোর চেয়ে খানিকটা ভিন্ন। আগের চার আসরে তিনটি সেঞ্চুরি করা গেইল এর আগে কখনো ফাইনালে সেঞ্চুরি করতে পারেননি। আজ ফাইনালে শুধু সেঞ্চুরিই করেননি, তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৮টি বিশাল ছক্কা। যা একদিকে যেমন তার নিজের এক ম্যাচে হাঁকানো সর্বাধিক ছক্কার রেকর্ড, অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসেও এক ম্যাচে সর্বাধিক ছক্কার রেকর্ড। ছক্কার নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়াসহ ৬৯ বলে ১৪৬ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে গেইল রংপুরের জয়ের নায়ক।
সেই সাথে ফাইনাল সেরা এবং তার চেয়ে বড় কথা ইলিমিনেটর রাউন্ড এবং ফাইনালে দু’দুটি ম্যাচ জেতানো শতরানের কৃতিত্বে আসর সেরা পারফরমারও গেইল। এমন সাফল্যের রূপকারকে কে না মনে রাখে? আজ শেরেবাংলায় খেলা দেখতে আসা ২৫ হাজার ক্রিকেট অনুরাগীর আজীবন মনে থাকবে গেইলের এই উত্তাল উইলোবাজি। প্রথম ৯ ম্যাচে দুটি হাফ সেঞ্চুরি করলেও বড় ইনিংস খেলা সম্ভব হয়নি তার।
অবশেষে জায়গামতো জ্বলে উঠলেন তিনি। এর পিছনের কাহিনী কী? গেইলের ব্যাখ্যা, ‘এর আগেও আমি স্টার্ট পেয়েছি। শুরু ভালোই হয়েছিল; কিন্তু আমি তা কাজে লাগিয়ে বড় ইনিংস খেলতে পারিনি। তবে খুব ভালো লাগছে, সময়মতো জ্বলে উঠতে পেরে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আসল ভালো খেলা ও সময়মতো জ্বলে ওঠার গুরুত্ব অনেক।’
তবে কথায় বুঝিয়ে দিলেন, তার নিজের চেষ্টা ছিল। পুরো দল তাকে এবং ম্যাককালামকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে অধিনায়ক মাশরাফি পুরো দলকে দারুণভাবে পরিচালিত করেছেন। বোলাররা দারুণ ভূমিকা রেখেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলেরা, ভালো করতে ও সাফল্যের জন্য মুখিয়ে ছিল।
শেষ পর্যন্ত ছক্কার বৃষ্টি বইলেও ৫৭ বলে শতরান, তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের মন্থরতম শতকের একটি। শুরুতে বেশ দেখে খেলেছেন। সেটা যতটা ঢাকার মাপা বোলিংয়ের কারণে। তার চেয়েও বেশি গেম প্ল্যানের অংশ হিসেবে।
দিন শেষে সংবাদ মাধ্যমের সামনে সে সত্য মেলে ধরে গেইল বলেন, ‘শুরুতে ঢাকার বোলাররা ভালো বল করেছে। আর আমরা ধীরে শুরু করেছি। চার্লস ফিরে যান শুরুতেই। ম্যাককালাম উইকেটে আসেন। তখন আমাদের একটাই কাজ ও লক্ষ্য ছিল, যত বেশি সময় উইকেটে থাকা যায়। আমরা সে চেষ্টাই করেছি। আমাদের দুজনার যেকোনো একজন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা এবং ইনিংস শেষ করে আসাটাও ছিল জরুরি। আর ধীরে ধীরে আমরাও ছন্দ ফিরে পাই। আমরা আরও একটা কাজ করেছি, তাহলো ঢাকার সেরা বোলারদের উইকেট দেইনি। এক কথায় শতভাগ টি-টোয়েন্টি উপযোগী উইকেট যদিও না, তারপরও এটা এমন এক ধরনের উইকেট যেখানে আপনি একবার সেট হয়ে গেলে ইচ্ছেমতো মারতে পারবেন। ফ্রি স্ট্রোক খেলতে পারবেন।’
আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লস শুরুতে আউট হবার পর তিনি আর ম্যাককালাম মিলে দ্বিতীয় উইকেটে শুরুতে দেখে খেলে শেষ পর্যন্ত ২০১ রানের বিশাল জুটি গড়েন। এর পিছনের কাহিনী কী? জানতে চাওয়া হলে গেইল বলেন, ‘আমরা পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে খেলার চেষ্টা করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। কখন ধরে খেলবো আর কখন সুযোগ বুঝে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে মারবো- এসব হিসাব-নিকাশ ও বুদ্ধি-পরামর্শ করেই খেলেছি। এরপর এক সময় গিয়ে স্ট্রাইকরেট বাড়ানো খুব জরুরি ছিল। আমার মনে হয়, সে কাজটি ম্যাককালাম আর আমি মিলে ভালোই করতে পেরেছি।’
তার ক্যারিয়ারের এটা ২০ নম্বর শতক। আজকের এই ইনিংসটির অবস্থান সেখানে কোথায়? আপনি আজকের শতরানকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে চান? এমন প্রশ্নের জবাবে গেইল বলেন, এক নম্বর ইনিংস অবশ্যই ১৭৫ রানেরটা। তবে আজকের শতরান অবশ্যই আমার সেরা পাঁচ সেঞ্চুরির মধ্যে একটি।’
সেটা শুধু ১৮ ছক্কা হাঁকানোর কারণে নয়। গেইলের মূল্যায়ন, এটা বিপিএলের মতো বড় ও আকর্ষণীয় আসরের ফাইনাল ছিল। অবশ্যই এটা একটা বড় মঞ্চ। এমন এক ম্যাচের গুরুত্ব অবশ্যই বেশি। ফাইনালে শতরান করতে পারা এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়া- সব মিলেই এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে।
এআরবি/আইএইচএস/বিএ/এআরএস