কুচকির ব্যথা নিয়েও আজ খেলবেন মাশরাফি
শেষ ম্যাচ খেলেননি। ড্রেসিং রুমেই বসা ছিলেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন শেষ চারে থাকা নিশ্চিত, তাই হয়তো বিশ্রামে মাশরাফি বিন মুর্তজা। আসলে তা নয়। ৬ ডিসেম্বর ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে খেলতে নামেননি ইনজুরির কারণে। গ্রোয়েনে (কুচকিতে) ব্যথা। এলিমিনেটর পর্বের আগে সে ব্যথা যাতে আর না বাড়ে, সে চিন্তায় শেষ ম্যাচ খেলেননি।
কবে কখন ইনজুরির শিকার হলেন মাশরাফি? কারো কারো ধারণা, খুলনা টাইটান্সের সঙ্গে ম্যাচেই বুঝি গ্রোয়েনে টান পড়েছে রংপুর অধিনায়কের। সে কারণেই ঐ ম্যাচের শেষ তিন ওভার মাঠে থাকা সম্ভব হয়নি। খুলনার সঙ্গে ম্যাচের শেষ অংশ অবশ্য তেমনটাই জানান দিচ্ছিলো। মনে করে দেখেন ঐ খেলার শেষ তিন ওভার মাঠে ছিলেন না রংপুর অধিনায়ক। শেষ ২৪ বলে খুলনার যখন ৪১ রান দরকার, তখন ১৭ নম্বর ওভার বল করে (সাত রান দিয়ে) সোজা ড্রেসিং রুমে হাঁটা দিলেন মাশরাফি। তা দেখেই অনেকের ধারণা, সে ম্যাচেই বুঝি ইনজুরির শিকার হওয়া।
আসলে তা নয়। ব্যথা পেয়েছেন ২ ডিসেম্বর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন; জিম করতে গিয়ে। কিন্তু নিরন্তর ইনজুরি আর অপারেশনের ধকল সামলে এগিয়ে চলা মাশরাফি কুচকিতে ব্যাথা নিয়েও দুই ম্যাচ খেলেছেন। সবার প্রশ্ন তাহলে আজ খেলবেন মাশরাফি?
জাগো নিউজের প্রশ্নের জবাবে রংপুর অধিনায়কের উত্তর ‘হ্যা খেলবো।’ মাশরাফি খেলবেন নিশ্চিত। তবে ভেতরের খবর, গ্রোয়েনে ব্যথা নিয়েই শুক্রবার দুপুরে খুলনা টাইটান্সের সঙ্গে মাঠে নামবেন। কুচকির ব্যথা আছে এখনো।
এ যেন সেই ‘ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধনুক ভাঙ্গা পণ। ইতিহাস জানাচ্ছে প্রবল ঝড়েও ‘দামোদর’ নদী সাতরে অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। আজকের ম্যাচের আগে মাশরাফির অবস্থা তাই। ব্যথা ভোগাচ্ছে। তবুও যে খেলতেই হবে। ‘মাশরাফি’ সব সময়ই এক সংগ্রামী ক্রিকেটারের নাম। ইনজুরি, অপারেশনকে জয় করা এক অসীম সাহসী ও অফুরান প্রাণশক্তি উদ্যমী ক্রিকেট যোদ্ধা।
মাঠে শতভাগ দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় সচেষ্ট সব সময়ই। তবে এবারের বিপিএলে ভালো করার এবং দলকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ইচ্ছেটা বরং আরও প্রবল ছিল। বিপিএলের প্রতিটি ম্যাচে তাই মাশরাফিকে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে একটু বেশি সিরিয়াস মনে হয়েছে। মধ্য তিরিশে দাঁড়িয়েও একজন ক্রিকেটার কতটা সিরিয়াস থাকতে পারেন, মূল কাজ বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ফিল্ডিংয়ে শতভাগ উজার করে দিতে পারেন, মাশরাফি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
বল হাতে ১৩ উইকেট আর ব্যাটে ১৩১ রান দেখে মনে হতে পারে এ আর এমন কি? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঐ উইকেটগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজনের সময় নেয়া। এবং সেটা খুব কম রান দিয়ে। ওভার পিছু দিয়েছেন মোটে ৬.৫৮ রান। ব্যাট হাতে যে রান করেছেন, তাও দরকারের সময়। অন্তত দুই ম্যাচে রংপুর জিতেছে ‘ব্যাটসম্যান মাশরাফির হাত ধরে।
এর মধ্যে ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিলেট সিক্সার্সের সাথে ১০ বলে ১৭ রানের হার না মানা ইনিংসটিই রংপুরকে জিতিয়ে দেয়। ইংলিশ পেসার ব্রেসনানের করা খেলার শেষ ওভারের চতুর্থ ডেলিভারিতে মাশরাফির বিশাল ছক্কায় দুই বল আগে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় রংপুর।
এর আগে ২৫ নভেম্বর স্বাগতিক চিটাগাং ভাইকিংসের ১৭৭ রানের বড় স্কোর টপকাতে গিয়ে সবাইকে অবাক করে তিন নম্বরে নেমে ২৪৭.০৫ স্ট্রাাইকরেটে ১৭ বলে ৪২ রানের হ্যারিকেন ইনিংস খেলে রংপুরকে জয়ের পথ দেখান মাশরাফি। ঐ ইনিংসেই গড়ে ওঠে জয়ের ভীত। এছাড়া এবার ফিল্ডার মাশরাফিও আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি চপল। সচেতন ও ক্ষিপ্র। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৩০ গজের ভেতরে দারুণ ফিল্ডিং করে রান বাঁচিয়ে দলের উপকার করেছেন কয়েকবার।
স্লো আর লো উইকেটে কোন লাইন ও লেন্থে বল করলে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের হাত খুলে খেলা থেকে বিরত রাখা যাবে তা মাশরাফির চেয়ে আর ভালো জানে কে? এসব কন্ডিশনে গতি কমিয়ে লেন্থ ঠিক রাখাই সবচেয়ে বড় কৌশল। সেই ফর্মুলা খাটিয়ে মাশরাফি শতভাগ সফল। একজন ব্যাটসম্যানও তার বলে অবলীলায় চার-ছক্কা হাকাতে পারেননি। তাই তার বলে রান উঠেছে কম। প্রায় প্রতি খেলাতে রংপুরের সবচেয়ে মিতব্যয়ী স্পেলটি ছিল মাশরাফির।
তাই তো এখন পর্যন্ত উইকেট প্রাপ্তিতে সাকিব, আবু জাইদ রাহি, সাইফুদ্দীন ও আবু হায়দার রনি ও তাসকিন আহমেদের পেছনে ছয় নম্বরে থাকলেও সেরা ১০ উইকেট শিকারির মধ্যে ওভার পিছু রান দেয়ায় সাকিবের (৬.৩৩) ঠিক পেছনে মাশরাফি (৬.৫৮)।
ক্রিস গেইল আর ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মত বিশ্ব তারকা দলে। যারা তিন ফরম্যাটেই বিশ্ব মানের পারফরমার ও তারকা। এর মধ্যে টি-টোয়েন্টিতে সেরাদের সেরা দুইজন। সেই গেইল আর ম্যাককালাম দলে থাকার পরও রংপুরের চালিকাশক্তি মাশরাফি। তার যোগ্য গতিশীল নেতৃত্ব আর বল ও ব্যাট হাতে সময় মত জ্বলে ওঠাই রংপুরের বড় শক্তি।
সেই মাশরাফি এলিমিনেটর পর্বের বাঁচা মরার লড়াইয়ে শতভাগ সুস্থ নন। গ্রোয়েন ইনজুরির শিকার। বার বার ভয়াল থাবা দিয়েছে। কিন্তু ‘ইনজুরি’ তার পথ চলায় বাঁধা হতে পারেনি। ইনজুরিকে জয় করেই ক্যারিয়ারে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন নড়াইলের সাহসী ক্রিকেট যোদ্ধা। ভাগ্যের বিরম্বনা! খুলনা টাইটান্সের সঙ্গে এলিমিনেটর পর্বে আবার সেই ইনজুরির শিকার। আজ দুপুরে কুচকির ব্যথা নিয়েই মাঠে নামবেন রংপুর অধিনায়ক। তার আকাশছোয়া মনোবল আর ভালো করার অদম্য স্পৃহা দিয়ে আবারো ইনজুরিকে জয় করবেন মাশরাফি? তার হাত ধরেই হয়তো আবারো হাসবে রংপুর?
এআরবি/এমআর/আইআই