বিপিএলে সুপার ফ্লপ স্থানীয় ব্যাটসম্যানরা
অঘ্রাণের প্রথম দিন সাত সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি। চললো সারা দিন। রাত অবধি। তাতেই খেলা বন্ধ বিপিএলের। দুপুরে সিলেট সিক্সার্স আর খুলনা টাইটান্স ম্যাচ হয়নি। সন্ধ্যায় ঢাকা ডায়নামাইটস ও চিটাগং ভাইকিংসের খেলাও মাঠে গড়ায়নি।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিশ্রাম। ১৭ নভেম্বর, শুক্রবার আবার মাঠে গড়াবে বিপিএল। খেলা হলে যত কথা-বার্তা হয় ম্যচ নিয়ে। ম্যাচের চালচিত্র, ব্যক্তিগত ও দলগত পারফরমেন্স নিয়ে। যেহেতু আজ দুই ম্যাচের কোনটাই হয়নি, তাই অন্য দিনের তুলনায় বিপিএলের নানা দিক, বিশেষ কওে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স নিয়েই হলো যত কথা।
প্রথম কথা হলো যে কোনো কারণেই হোক, এবারের বিপিএল এখনো জমে ওঠেনি। নতুন ভেন্যু সিলেটে চার দিনের প্রথম পর্বটা মোটামুটি উপভোগ্য ছিল; কিন্তু রাজধানীতে মিরপুর শেরে বাংলায় গত ক’দিনের মধ্যে শুধু আগের দিন (মঙ্গলবার ) ঢাকা ডায়নামাইটস আর খুলনা টাইটান্স ম্যাচটি ছাড়া বাকি খেলাগুলোর বেশির ভাগই ছিল প্রাণহীন। নিস্তেজ, জৌলুস ও আকর্ষণহীন।
টি-টোয়েন্টি হচ্ছে এমন এক ফরম্যাট, যেখানে ক্রিকেটের আভিজাত্য, চিরায়ত সৌন্দর্য্য, সৃষ্টিশীলতা ও শৈল্পিকতা অনেক কম। এটা আসলে বিনোদন নির্ভর। যেখানে ব্যাকরণের চেয়ে চার-ছক্কার প্রদর্শনীটাই মূল।
গতকাল ঢাকা ডায়নামাইটস আর খুলনা টাইটান্সের ম্যাচেই শুধু চার-ছক্কার অনুপম প্রদর্শনীর দেখা মিললো। ঢাকায় এখন পর্যন্ত হওয়া ছয় মাচের বেশিরভাগ লো স্কোরিং। সিলেটে দুটি খেলায় রান ২০০‘র ঘরে ছিল; কিন্তু ঢাকায় ছয় ম্যাচে এখন পর্যন্ত কোন দল ১৮০‘র ঘরেও যেতে পারেনি।
দর্শক মাঠে আসেনই রানের প্রদর্শনী দেখতে, সেখানে লো স্কোরিং গেম আর চার ও ছক্কার জৌলুসের বদলে ম্যাড়মেড়ে ক্রিকেট দর্শক-সমর্থক ও ভক্তদের ভালো লাগার কথা নয়। তেমন ভালো লাগছেও না।
দর্শক, ভক্ত-সমর্থকদের কাছে এবারের বিপিএল কম সাড়া ফেলা এবং কম উপভোগ্য হবার আরও একটি বড় কারণ, স্থানীয় ক্রিকেটারদের বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা। এখন পর্যন্ত একজন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানও আলো ছড়াতে পারেননি এ বিপিএলে।
আজ পর্যন্ত হওয়া ১৪ ম্যাচে বাংলাদেশের একজন মাত্র ব্যাটসম্যান হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। সেটা মুমিনুল হক। রাজশাহী কিংসের এ বাঁ-হাতি উইলোবাজই একমাত্র বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান, যার ব্যাট পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছেছে।
গত ১১ নভেম্বর রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে শেরে বাংলায় ৬৩ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়েছেন মুমিনুল হক। আর একজনও এখন পর্যন্ত হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি। ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, সাব্বির রহমান রুম্মন, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও নাসির হোসেন- একঝাঁক জাতীয় তারকার সবাই ব্যর্থতার মিছিলে।
একটি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকাতে না পারলেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ইমরুল কায়েস তাও একটু-আধটু পারফর্ম করেছেন। দেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বেশি (চার ম্যাচে ১৩৪) রান ইমরুলের। সর্বোচ্চ ৪৫। এছাড়া লিটন দাস (৪ ম্যাচে ৮৮, সর্বোচ্চ ২৩), সৌম্য সরকার (চার ম্যাচে ৭৫, সর্বোচ্চ ৩৮), সাকিব আল হাসান (৪ ম্যাচে ৬২, সর্বোচ্চ ২৩), ( মুশফিক ৪ ম্যাচে ৩৮, সর্বোচ্চ ১৬), মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (৪ ম্যাচে ৮৫, সর্বোচ্চ ৪০)- কারো ব্যাটেই রান নেই। সবাই ভুগছেন রান খরায়।
শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাই নন, জাতীয় দলের বাইরে থাকা কেউ সেভাবে নজর কাড়তে পারেননি। শাহরিয়ার নাফীস আর রনি তালুকদার এবং মোহাম্মদ মিঠুন শুরু করেছিলেন ভালোই; কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে তারাও কেমন যেন নিষ্প্রভ।
রনি তালুকদার প্রথম দিন লাসিথ মালিঙ্গা ও থিসারা পেরেরার মতো বোলারের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে লড়ে ৪৭ রান করার পর হারিয়ে গেছেন। এর পরের তিন ম্যাচের তার রান মোটে ১০। সে তুলনায় রংপুর রাইডার্সের দুই উইলোবাজ শাহরিয়ার নাফীস (তিন ম্যাচে ৮৪, সর্বোচ্চ ৩৫) আর মোহাম্মদ মিঠুন (তিন ম্যাচে ৮৭, সর্বোচ্চ ৪৬) গড়পড়তা ধারাবাহিকভাবে রান করছেন। বাকি একজন ব্যাটসম্যানের অবস্থাও ভালো না।
স্থানীয় উইলোবাজরা সুবিধা করতে না পারলেও বাংলাদেশের বোলাররা কিন্তু দারুণ ফর্মে। ঢাকা ডায়নামাইটসের আবু হায়দার রনি আর খুলনা টাইটান্সের আবু জায়েদ রাহী এখন পর্যন্ত যৌথভাবে বিপিএলের সর্বাধিক উইকেট শিকারী। বাঁ-হাতি পেসার আবু হায়দার রনি আর ডান হাতি মিডিয়াম পেসার আবু জায়েদ রাহী দু’জনই সমান ৪ খেলায় ৭ উইকেট দখল করে সবার ওপরে। রনির সেরা বোলিং ১৩ রানে ৩ উইকেট। আর রাহীর সেরা ফিগার ৪-৩৫।
উইকেট প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের শফিউল (চার ম্যাচে ৬টি), তাসকিন (চার ম্যাচে ৬টি) আর সানজামুল ইসলামও (চার ম্যাচে ৫টি) আছেন ওপরের দিকে। তাইজুল, ফরহাদ রেজা, আবুল হাসান রাজুর অবস্থান ঠিক তাদের পিছনে। প্রত্যেকে সমান ৫টি করে এবং দুই পেসার সাইফউদ্দীন ও শুভাশিস রায় সমান চারটি করে উইকেট পেয়েছেন।
সে তুলনায় দেশ সেরা স্পিনার সাকিব আল হাসান খানিকটা পিছিয়ে। এ বাঁ-হাতি স্পিনারের ঝুলিতে এখন পর্যন্ত জমা পড়েছে (৪ ম্যাচে ১১ ওভার বল করে ৯০ রানে) ৩ উইকেট। মাহমুদউল্লাহ চার ম্যাচে ৭ ওভার বল করে ৫৮ রানে পেয়েছেন ৩ উইকেট।
নাসির প্রথম দুই ম্যাচে প্রাথমিক ব্রেক থ্রু এনে দেবার পাশাপাশি তিন উইকেট শিকার করলেও পওে আর সুবিধা করতে পারেননি। পাঁচ ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা এখনো তিনেই স্থির। অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজের অবস্থাও ভালো নয়। চার ম্যাচে ১৩ ওভার বল করা মিরাজ ৮৩ রানে পেয়েছেন মোটে ২ উইকেট।
উপুল থারাঙ্গা যদি রান তোলায় সবার ওপরে থাকতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত উইলোবাজদের এমন করুন দশা কেন? কেনই বা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা এত পিছনে? এ প্রশ্ন সবার।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ধারনা, অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই বেকায়দায় স্থানীয় ব্যাটসম্যানরা। এভিন লুইস, জস বাটলার, ব্র্যাথওয়েট, কাইরণ পোলার্ডরা শারীরিক দিক থেকে অনেক বেশি সুঠাম ও দীর্ঘদেহী। তাদের বিগ হিটগুলো যে খুব ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে একদম শরীর ও পা ঠিক বলের পিছনে গিয়ে নেয়া- তা নয়। বেশীর ভাগই পাওয়ার হিটিং।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শারীরিক সামর্থ্য তুলনামূলক কম। তারা কোনোভাবেই তেমন পাওয়ার হিটিং করতে পারবেন না। তারা বরং নিজের মেধা-বুদ্ধি খাটিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করলে সফল হবেন।
তার প্রমাণ গতকাল জহুরুল ইসলাম অমি আর ইমরুল কায়েসের একজোড়া চল্লিশোর্ধ ইনিংস। ব্র্যাথওয়েট আর পোলার্ড এবং বাটলারদের মতো ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে না পারলেও তারা বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিক ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং করেই মধ্য চল্লিশে চলে গেছেন। ম্যাচও জিতিয়েছেন।
কিন্তু ওপরের দিকে লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও সাব্বিররা উইকেটে গিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিগ হিট নিতে গিয়ে আর চার ও ছক্কার ফলগুধারা বইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেই কম সময় ও কম সংগ্রহে সাজঘরে ফেরত আসছেন।
এআরবি/আইএইচএস/এমএস