হাথুরুসিংহে : বিতর্ক আর সাফল্য এগিয়েছে পাশাপাশি
২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একমাস পরই বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন শেন জার্গেনসেন। এরপরই গুঞ্জন ওঠে, কে হবেন বাংলাদেশ দলের কোচ? বিসিবিও শুরু করে নতুন কোচের সন্ধান। ওই বছরই মে মাসে বিসিবি বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ হিসেবে অখ্যাত চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নাম ঘোষণা করে। যার কোনো ভারি প্রোফাইল ছিল না। কোনো জাতীয় দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা নেই।
সাবেক লঙ্কান ক্রিকেটার হাথুরুর অভিজ্ঞতা বলতে আরব আমিরাতের কোচ হিসেবে ১ বছর দায়িত্ব পালন, শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের কোচ এবং জাতীয় দলে ট্রেবর বেলিসের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন। বেলিসের সহকারী হিসেবে ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালের জুনে এসে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে হাথুরুকে বরখাস্ত করে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড।
জিম্বাবুয়ে সফর শেষে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল দেশে ফিরে এলেও হাথুরু দেশে ফেরেননি। বোর্ডকে না জানিয়েই তিনি অস্ট্রেলিয়ায় একটি কোচিং কোর্সে অংশ নেন। এ কারণেই মূলতঃ বরখাস্ত হন হাথুরু। ওই সময় শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। তিনি বোর্ডের কাছে অনুরোধ করেছিলেন হাথুরুকে বরখাস্ত না করার জন্য; কিন্তু সাঙ্গাকারার অনুরোধ সত্ত্বেও হাথুরুকে পূনরায় নিয়োগ দেয়া হয়নি। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়ে যান তিনি।
২০১১ বিশ্বকাপের সময় হাথুরু ছিলেন কানাডা ক্রিকেট দলের কোচিং পরামর্শক। বিশ্বকাপের পর বেশ কয়েকমাস বসেছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বরে এসে অস্ট্রেলিয়ায় নিউ সাউথ ওয়েলসে সহকারী কোচ হিসেবে ২ বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পান। এখানেই ভাগ্য খুলে যায় হাথুরুর। যখন, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মৌসুমের মাঝামাঝি এসে নিউসাউথ ওয়েলসের প্রধান কোচ অ্যান্থোনি স্টুয়ার্ট পদত্যাগ করেন। হাথুরুকে এ সময় মৌসুমের বাকি অংশের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
কিন্তু মৌসুম শেষে নিউসাউথ ওয়েলস তাকে প্রধান কোচ না করে ট্রেবর বেলিসকেই প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। হাথুরুকে রেখে দেয়া হয় সিনিয়র সহকারী হিসেবে। এ সময় এসে বিগ ব্যাশ লিগে সিডনি থান্ডারের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পান হাথুরু। নিউসাউথ ওয়েলসের নতুন ক্রিকেট সিস্টেম অনুযায়ী এ দায়িত্ব পান তিনি।
২০১৪ সালের মে মাসে এসে বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পান চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর হাথুরুর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজ। এই সিরিজে খুবই বাজে পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ। আবার এই সিরিজেই ড্রেসিংরুম ছেড়ে এসে দর্শকের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারণে ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। অনেকেই মনে করেন, হাথুরুর কারণেই এই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়েছিল সাকিববে। যে কারণে সেরা এই পারফরমারকে ছাড়াই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশকে এবং ওই সিরিজে দারুণ ভরাডুবি ঘটে বাংলাদেশের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের পরই বাংলাদেশে আসে জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক পরিবর্তন করেন হাথুরু। যদিও তার এই সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুবই মঙ্গলজনক। কারণ, তিন ফরম্যাটে মুশফিকুর রহীমকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক করা হয় মাশরাফিকে। এরপরই বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ দলের চেহারা। জিম্বাবুয়েকে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ দিয়েই বাংলাদেশ এবং হাথুরুর সাফল্যের পথে হাত ধরাধরি করে হাঁটা শুরু।
বিতর্কও ওই সময় থেকে দানা বাধতে শুরু করে। বিশেষ করে, হাথুরুর ছুটির বিষয়গুলো বেশ আলোচিত হতে থাকে মিডিয়ায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময়ই তাকে নিয়ে বিতর্ক প্রথম প্রকাশ্যে আসে। বিশ্বকাপের জন্য যে দল ঘোষণা করা হয় তাতে রাখা হয় লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখনকে। দল ঘোষণার পর হাথুরু প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেন, দল নিয়ে তার মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি বলে। এ নিয়ে ক্রিকেটপাড়ায় বেশ গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। দল কে তৈরি করেন তা নিয়ে।
ওই সময়ই ক্রিকেপ অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান, সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন হাথুরু। যদিও বিষয়টা প্রকাশ্যে মিডিয়ায় কেউ স্বীকার করেননি। তবে, বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের মত দলকে হারিয়ে দিল, খেললো কোয়ার্টার ফাইনালে, তখন তো হাথুরুর ক্ষমতা এবং চাহিদা বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। বিশ্বকাপের পরপরই হঠাৎ ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন দুর্জয়। এ সময় তিনি হাথুরুর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনাও করেন।
কারণটা উহ্য রাখা হলেও, ক্রিকেট পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে হাথুরুর সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই বোর্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন দুর্জয়। গুঞ্জন রয়েছে, হাথুরুর চাহিদা মোতাবেকই পুনরায় ক্রিকেট অপারেশন্সে ফিরিয়ে আনা হয় আকরাম খানকে।
হাথুরুর এসব বিতর্ক ঢাকা পড়ে যায় তার সাফল্যের সামনে। কারণ, যে পাকিস্তানকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আর হারানো যায়নি, তাদেরকে ঘরের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করার পাশাপাশি ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় উপহার দেন তিনি। ঘরের মাঠে এরপর জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে বাংলাদেশ খেলে টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপের ফাইনালও। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ভালো ফলাফল করতে পারলেও চূড়ান্ত পর্বে ফল ছিল শূন্য।
তবুও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর বিসিবি পারিশ্রমিক বাড়িয়ে হাথুরুর সঙ্গে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি করে। হাথুরুর যে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়, তাতে তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত ক্রিকেট কোচদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে চলে আসেন। কিন্তু বিতর্ক তৈরি হয়, যে কোনো সিরিজ শেষে তার অনুপস্থিতি নিয়ে। কোনো সিরিজ শেষ হওয়া মাত্রই দলের সাথে দেশে ফিরে না এসে তিনি চলে যান ছুটিতে। দলের কোথায় ঘাটতি, কোথায় দুর্বলতা, কী কী সমস্যা- এগুলো সমাধানের যে সময়টা, সেটা তিনি কখনোই কাজে লাগান না। দীর্ঘদিন ছুটি কাটানোর পর আবার তিনি ফিরেন কোনো না কোনো সিরিজ কিংবা টুর্নামেন্টের ঠিক আগ মুহূর্তে।
এরই মধ্যে হাথুরুর ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে যায় যে, তিনি নির্বাচক কমিটিতে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছেন। বিসিবিকে দিয়ে তিনি গঠন করেছেন দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি। এক স্তরে তিনি নিজেই থাকবেন অন্যতম নির্বাচক হিসেবে। বিষয়টা তুমুল সমালোচনার জন্ম দিলেও বিসিবি ঠিকই তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি গঠন করে। যার জের ধরে প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান, সফল নির্বাচক ফারুক আহমেদ। তার বক্তব্য ছিল, নতুন এ সিস্টেমের কারণে নির্বাচকদের দল নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাই থাকবে না।
আদতে হয়েছেও সেটা। নতুন প্রধান নির্বাচক করা হয় মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে। বাকি দুই নির্বাচক যথারীতি হাবিবুল বাশার সুমন এবং সাজ্জাদ আহমেদ শিপন। এ কমিটি যে নিজেদের ক্ষমতায় কোনো দল নির্বাচন করতে পারে না, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ গত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। এই সিরিজের জন্য ঘোষিত দল থেকে হঠাৎ করেই বাদ দেয়া হলো মুমিনুল হককে।
টেস্ট ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল এবং নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান যিনি। তুমুল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত বিসিবি সভাপতিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তার প্রভাবেই মুমিনুল আবার দলে সুযোগ পান। যদিও সেই সুযোগটা তৈরি হয়েছিল মোসাদ্দেক হোসেনের চোখের ইনজুরির কারণে; কিন্তু বিসিবি সভাপতি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ১৪ জনের পরিবর্তে ১৫ জনের দল করেও তো মুমিনুলকে দলে রাখা যেতো।
যে জুবায়ের হোসেন লিখনকে নিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন হাথুরু, তাকেই আবার গত বছর শেষ দিকে এসে ছুড়ে ফেলে দেন তিনি। তার পরিবর্তে একজন লেগ স্পিনার প্রয়োজন বলে নিউজিল্যান্ড সফরে দলে নেন অপরিপক্ব তানবির হায়দারকে। শেষ পর্যন্ত সেই তানবিরও ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। গত শ্রীলঙ্কা সফরে মাহমুদউল্লাহকে দল থেকে বাদ দেয়া, মুমিনুলকে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। তার আগে ভারত সফরে মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্ব এবং উইকেটকিপিং নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন তিনি।
পছন্দের খেলোয়াড় নির্বাচন, পছন্দের লোকদের বিভিন্ন পদে বসানোর রাজনীতি শুরু করেন হাথুরু। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে টেস্ট জয়, কিংবা গত বছর ইংল্যান্ডকে হারানো, শ্রীলঙ্কার মাটিতে শততম টেস্ট জয় তাকে নিয়ে সব বিতর্ককে ঢেকে দেয়।
তবে হাথুরু সবচেয়ে বেশি বিতর্ক জন্ম দেন এবারের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শেষ হওয়ার পরই তিনি চলে যান নিজের বাড়ি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সেখান থেকে যোগ দেন দলের সঙ্গে জোহানেসবার্গে। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্টে টস জিতে ফিল্ডিং নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকটাই ছিল হাথুরুর। মুশফিকুর রহীম সংবাদ সম্মেলনে হাথুরুর নাম না বললেও, তিনি জানিয়েছেন এ সিদ্ধান্তগুলো ছিল ম্যানেজমেন্টের। আর সবারই জানা, ম্যানেজমেন্ট বলতে হাথুরুরই একচ্ছত্র ক্ষমতা। এখানে আর কারও কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া মুশফিকের ফিল্ডিং পজিশন ঠিক করে দেয়া নিয়েও বেশ সমালোচনার জন্ম হয়।
শেষ পর্যন্ত তুমুল বিতর্ক আর সমালোচনা বাংলাদেশ দলের হয়ে হাথুরুর প্রায় সব সাফল্যকেই ঢেকে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন নিজেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রয়োজনে ছুটি থেকে ডেকে এনে হাথুরুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার গুঞ্জনটাও সত্যি হতে চলেছে। এ কারণেই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে থাকতে পারেন হাথুরু। সে লক্ষ্যেই হয়তো পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছেন বিসিবিতে।
আইএইচএস/আইআই