ঢাকার পর সিলেটের শিকার কুমিল্লাও
কুমিল্লার মিডিয়াম পেসার ডোয়েন ব্রাভোর করা খেলার শেষ ওভারের প্রথম বলে বোল্ড শুভাগত হোম। স্বাগতিক সমর্থকদের কোলাহল থেমে হঠাৎ মাঠে কবরের নিস্তব্ধতা। কী হয়, কী হয় অবস্থা! এরকম স্নায়ুক্ষয়ী পরিস্থিতিতে উইকেটে আসলেন সিলেট সিক্সার্স উইকেটকিপার নুরুল হাসান সোহান।
উইকেটে এসে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকালেন সোহান। পেসার ব্রাভোর ফুল লেন্থ ডেলিভারিকে সামনের পায়ের ওপর ভড় করে লং অনের ওপর দিয়ে চালালেন সোহান। বল বাতাসে ভেসে লং অন ফিল্ডার রশিদ খানের মাথার ওপর দিয়ে ছিটকে পড়লো সীমানার ওপারে গিয়ে।
চার বলে চার রান দরকার থাকা অবস্থায় প্রথমে সোহান আর পরে প্ল্যাঙ্কেট দুটি সিঙ্গেল নিলেন। দুই বলে তখন দুই দরকার সিলেটের। ঠিক এমন অবস্থায় আবার স্ট্রাইকে সোহান। যা হয় হবে, আমি সামনে বেড়িয়ে চালাবো-ব্যাটসম্যানের এমন মতি গতি দেখে অফস্টাম্পের বাইরে থ্রি কোয়ার্টার লেন্থে বল ফেললেন ব্রাভো।
বেশির ভাগ সময় আন-অর্থোডক্স শট খেলতে অভ্যস্ত সোহান ঠিক কাট আর লেট কাটের মাঝামাঝি এক শর্ট খেললেন, শর্ট থার্ডম্যান ফিল্ডারের নাগালের বাইরে দিয়ে বল চলে গেল সীমানার ওপারে। এরই সঙ্গে ৪ উইকেটের এক মনে রাখার মতো জয় ধরা দিলো সিলেট শিবিরে।
বল শর্ট থার্ডম্যান ফিল্ডারকে ফাঁকি দিয়ে সীমানার ওপারে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়লেন সোহান। ডাগ আউটে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ফারুক আহমেদের সঙ্গে বসে থাকা অধিনায়ক নাসির আনন্দের আতিশয্যে দৌঁড়ে মাঠে ঢুকলেন।
নন-স্ট্রাইকার প্ল্যাঙ্কেট আর অন্যান্য ক্রিকেটাররাও মাঠের ভিতরে গিয়ে সোহানকে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের আনন্দ-উল্লাস আর উৎসবের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন সোহান। গ্যালারিতে তখন আনন্দের বন্যা। ‘সিলেট সিক্সার্স, সিলেট সিক্সার্স’- স্লোগানের সঙ্গে ‘সোহান-সোহান’ ধ্বনিও যুক্ত হলো। যা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ছড়িয়ে পড়লো গোটা লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকায়।
সিলেট ভক্তরা উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা হতেই পারেন। প্রিয় দল প্রথমবারের মতো নিজ শহরে। তাতে পর পর দুই ম্যাচে জয়ের দেখা। ভালো লাগারই কথা। খুশির ফলগুধারা বয়ে যাবার মতোই উপলক্ষ। যে সব সিলেটবাসী মাঠে এসে নিজ দলের খেলা দেখেছেন তারা স্বার্থক।
আগের দিন ছিল উপচেপাড়া ভিড়। আজ রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্ম দিবস। ঘড়ির কাটা দুপুর একটা ছাড়িয়ে দেড়টা স্পর্শ করার সময়ও মাঠের অর্ধেক চেয়ার খালি ছিল। কিন্তু ঘণ্টা খানেক না যেতেই ভোজবাজির মতো বদলে গেল দৃশ্যপট। খেলা শুরুর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পূর্বদিকের গ্যালারি প্রায় ভরে গেল। তারপর সমর্থকদের মুহুর্মুহু করতালি, গগণ-বিদারি চিৎকার ও অকুণ্ঠ সমর্থন।
শুধু স্টেডিয়ামের চালচিত্র আর স্বাগতিক ভক্তদের মাঠ উপস্থিতি আর সমর্থনই নয়, নাসিরের সিলেট সিক্সার্সের বোলিং এ্যাপ্রোচ-এ্যাপ্লিকেশন আর পারফরমেন্সটাও হলো ঠিক আগের দিনের মতো। দুই স্পিনার নাসির- তাইজুল আর পেসার সান্তোকির মাপা বোলিংয়ে ১৫৪ ‘তে থামলো শক্তিশালি কুমিল্লা।
আগের দিন ঢাকার বিপক্ষে যাদের চওড়া ব্যাটে গড়ে উঠেছিল জয়ের মজবুত ভীত, সেই দুই ওপেনার উপুল থারাঙ্গা আর ফ্লেচার জুটি আবারও ব্যাট হাতে দ্যূতি ছড়ালেন। ১৫৫ রান করতে গিয়ে থারাঙ্গা আর ফ্লেচার জুটিতে উঠলো ৭৩ রান (৮.৪ ওভারে)। তারপর হঠাৎ ছোট্ট মড়ক। আর শেষ দিকে সোহানের হাত ধরে স্মরণীয় জয়। পর পর দুই ম্যাচে দুই ফেবারিট ঢাকা ও কুমিল্লা ধরাশায়ী সিলেটের কাছে।
শেষ দিকে হিসেব নিকেশ কঠিন হওয়া ছাড়া সিলেট সিক্সার্স খেলেছে প্রায় একই ছন্দ ও লয়ে। ঢাকার বিপক্ষে খেলার প্রথম ওভারে বল হাতে নিয়ে মেহেদি মারুফকে আউট করে ব্রেক থ্রু দিয়েছিলেন সিলেট অধিনায়ক নাসির।
আজও তিনিই বোলিংয়ের সূচনা করলেন। তবে প্রথম ওভারে উইকেট না পেলেও ঠিক দ্বিতীয় ওভারে ইমরুল কায়েস ( ১২) ফিরিয়ে প্রথম আঘাত নাসিরের। তার অফস্টাম্পের বাইরে থ্রি কোয়ার্টার লেন্থের ডেলিভারিকে কাট করতে গিয়ে বোল্ড কায়েস। ৩৬ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার পর কুমিল্লা ইনিংসের ছন্দপতন।
এ পিচ পেসারদের চেয়ে স্পিন বান্ধব। এ সত্য উপলব্ধি করেই তাইজুলকে অন্যপ্রান্তে বোলিংয়ে আনলেন সিলেট অধিনায়ক নাসির। আস্থা, আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে থাকা কুমিল্লা ওপেনার লিটন দাস একটু বেশি আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে উইকেট ছেড়ে মারতে গিয়ে হলেন স্টাম্পড। আর তাতেই বড় পুঁজি গড়ার পথ হলো সংকুচিত।
এরপর একা লড়লেন মারলন স্যামুয়েলস। ৪৭ বলে ৬০ রানের ইনিংস বেড়িয়ে আসলো এ ক্যারিবীয় তারকার ব্যাট থেকে। তার ওপর ভর করেই ১৫৪ তে গিয়ে ঠেকলো কুমিল্লা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো, ওই রান পর্যাপ্ত নয়। ইনফর্ম লঙ্কান উপুল থারাঙ্গা ( ৪০ বলে ৫১) আর ক্যারিবীয় আন্দ্রে ফ্লেচার (২৯ বলে ৩৬) প্রথম উইকেটেই এগিয়ে দিলেন অর্ধেক পথ।
কিন্তু সাব্বির (৩), অধিনায়ক নাসির (২০ বলে ১৮) ও হুইটলি (১৪ বলে ১০) সেই সাজানো পথে হাঁটতে গিয়েও পা পিছলে পরে গেলেন। আর সে কারণেই ৭৩ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর ৫৩ রানে পতন ঘটলো আরও ৫ উইকেটের। শেষ পর্যন্ত নুরুল হাসান সোহান ত্রাণকর্তা। তার তিন বলে ১১ রানের হার না মানা ইনিংসটিই ম্যাচ জেতানো ইনিংস হয়ে থাকলো।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম