নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত সিলেট স্টেডিয়াম
কথায় বলে ‘আকাশে চাঁদ উঠলে নাকি সবাই দেখে।’ চাঁদের স্নিগ্ধ আলো সবাই উপভোগ করে। মুগ্ধ হয়। একই ভাবে গাছে ফুল ফোটার পর তার সৌরভ নাকে গিয়ে লাগে। সুগন্ধে মন ভরে যায়। আসল ভাব হলো কোন কিছু দৃশ্যমান হলেই কেবল তার গুনাগুণ বিচার করা যায়। চাঁদ না দেখে যেমন চাঁদের সৌন্দর্য পরিমাপ করা যায় না, কিংবা ফুলের ঘ্রাণ না নিয়ে যেমন সুঘ্রাণের মাত্রা পরিমাপ করা যায় না, একইভাবে কোন নির্মাণ শৈলী, স্থাপনা দৃশ্যমান না হলেও তার সত্যিকার সৌন্দর্য বিচার করা যায় না।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম হলো তেমন এক স্থাপনা, যা চোখে না দেখলে তার প্রকৃত সৌন্দর্য অনুমান করা সম্ভব নয়। কিন্তু এতকাল এ ক্রিকেট ভেন্যুর সৌন্দর্য, স্থাপত্ব আর নির্মাণ শৈলী ছিল প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। এই মাঠে টেস্ট আর ওয়ানডে কিছুই হয়নি। তাই দর্শক, ক্রিকেট অনুরাগী, ভক্ত-সমর্থক ও অনুরাগীর বড় অংশ জানতেনই না সিলেট স্টেডিয়াম কত সুন্দর।
একটি উদাহরণ দেই, এখন অনুমান করে নিন। রাজধানী ঢাকার মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়াম যদি হয় দেশের সর্ববৃহৎ, আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু, তাহলে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্যে অনুপম ক্রিকেট স্টেডিয়াম হল ‘সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম।’
পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৃটিশ স্থাপত্বের ছোয়া আর নিপুণ নির্মাণ শৈলীর মিশেল এ ভেন্যুকে করেছে অনিন্দ সুন্দর। তাই নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম ক্রিকেট ভেন্যু হচ্ছে ‘সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম।’
সাধারণত স্টেডিয়াম মানেই শহরের কোলাহল তথা প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরে কোথাও অনেক একর জায়গার ওপর বড় স্থাপনা। ক্রিকেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামও তাই। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে চার কিলোমিটার দূরে। সিলেট তথা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ চা বাগান ‘লাক্কাতুরার’ ভেতরেই মাঠ। ঢোকার আগেই লাক্কাতুরা চা বাগান। চা বাগানের সতেজ সবুজ রূপ চোখ জুড়িয়ে দেবে। প্রায় ৫০০ গজের বেশি পায়ে হাঁটা পথ। যার দু'ধারে চা বাগান।
এরপর মূল মাঠ। একদিকে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড আর অন্যদিকে মিডিয়া ভবন। দুটিই বৃটিশ স্থাপত্বের অনুকরণে গড়া। শেরেবাংলা স্টেডিয়াম, ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম কিংবা খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড যেরকম ঠিক অমন নয়। কিছুটা ‘বাংলোর’ ধাচে গড়া। ছাদটা বৃটিশ স্থাপত্বের অনুকরণে লাল টালি দেয়া। মিডিয়া ভবনের নকশাও অন্য সব স্টেডিয়াম থেকে আলাদা।’
এটাই শেষ নয়। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবার আরও উপাদান আছে। বাংলাদেশের কোন ক্রিকেট ভেন্যুতে যা নেই, এ দেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা টিভির পর্দায় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকায় যে ‘গ্রিন গ্যালারি’ দেখে পুলকিত হন আর ভাবেন ইস আমাদের দেশে যদি এমন থাকতো, তাহলে শীতের সময় পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে মাদুর, পাটি কিংবা ম্যাচ বিছিয়ে শুয়ে বসে খেলা দেখতাম! সেই গ্রিন গ্যলারির দেখা মিলবে এই মাঠে।
মাঠের পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা জায়গা টিলার মত উঁচু। যার গা ভর্তি সবুজ ঘাস। সেই টিলাকে ১০ স্তরে গ্যালারির মত করে তোলা হয়েছে। তার গা ঘেষেই ইলেক্টনিক্স স্কোর বোর্ড। ঠিক পূর্ব পাশে সাধারণ গ্যালারি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চির পরিচিত ‘আবাহনী-মোহামেডান" গ্যালারির সমান জায়গা নিয়ে। অন্তত হাজার দশেক মানুষ চেয়ারে বসে খেলা দেখতে পারেন। কিন্তু সে সাধারণ গ্যালারিও হোম অফ ক্রিকেটের সাধারণ গ্যালারির চেয়ে সুন্দর করে সাজানো ও নির্মিত। শেরেবাংলার সাধারণ গ্যালারির ওপর কোন ছাউনি নেই। রোদে পুরেই খেলা দেখতে হয়। কিন্তু এখানে রোদে পুরতে হবে না। যেহেতু পূর্ব দিকে এর অবস্থান, তাই চমৎকার ছাউনি বা শ্যেড আছে ওপরে। অতবড় ছাউনি বড় একটা চোখে পড়েনি বাংলাদেশের কোন স্টেডিয়ামের সাধার গ্যালারির ওপর।
২০১৪ সালে বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরে এ ভেন্যু আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের ২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ম্যাচ দিয়ে ভেন্যু হিসেবে আন্তর্জাতিক অভিষেক। সেই ম্যাচসহ মোট ছয়টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোন খেলা হয়নি সিলেট মাঠে। তাই সাধারণ দর্শকের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে সিলেট স্টেডিয়ামের সত্যিকার সৌন্দর্য।
তবে আজ (শনিনার) দুপুরে সাকিব আল হাসানের ঢাকা আর নাসিরের সিলেটের ম্যাচ দিয়ে এ স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য সবার চোখে পড়বে। টিভি ক্যামেরা ক্রুরা মাঠের চারপাশকে ঠিকমত ক্যামেরাবন্দী করতে পারলে সবাই দেখবেন, জানবেন ও বুঝবেন কত সুন্দর এই ভেন্যু। বলে দেয়া যায়, এবারের বিপিএল শুরুর দিন মাঠের ক্রিকেটের চেয়ে বেশি কথা হবে সিলেট স্টেডিয়ামের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য নিয়ে।
১৮ হাজার দর্শকের আসন বিশিষ্ট এ দৃষ্টিনন্দন ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখে মুগ্ধ দেশের সব জাতীয় ক্রিকেটারই। মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত। তাদের সবার এক কথা, ‘দেখতে দারুণ সুন্দর স্টেডিয়াম।
রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক মাশরাফি স্টেডিয়াম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে ওঠেন, ‘সিলেটে তিন-চার বছর আগে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছিলাম। এবার আসলাম বিপিএল খেলতে। খুব ভালো লাগছে। এটা আন্তর্জাতিক মানের মাঠ। গ্যালারি ও ড্রেসিংরুম যেমন দেখলাম, সেটা পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মানের। আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দর্শকদের গ্যালারি অনেক ভালো হয়েছে। এছাড়া এখানে চারটি ড্রেসিং রুম আছে, মাঠটাও দেখতে দারুণ সুন্দর।’
বাংলাদেশের যে ক্রিকেটার বিশ্বের বহু মাঠে খেলেছেন, সেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবের কাছেও মাঠ খুব ভালো লেগেছে। তার কথা, ‘সিলেট সব সময় আমার ফেবারিট ভেন্যুর মধ্যে একটা। কারণ আশপাশটা সুন্দর। ঘোরার মত জায়গা আছে। সুন্দর সুন্দর হোটেল আছে। স্টেডিয়ামটাও দেখতে বিদেশি স্টেডিয়ামের মতো। আমার কাছে মনে হয় অনুপম সৌন্দর্যের প্রতীক এই স্টেডিয়াম।’
খুলনা টাইটান্সের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বলেন, ‘এখানে সর্বশেষ আম্বার কাপ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয়েছিল। তখনকার চেয়ে এখন আরও অনেক বেশি সুন্দর লাগছে স্টেডিয়াম ও গ্যালারি।’
এআরবি/এমআর/জেআইএম