শুরু হলো সাকিবের নতুন মিশন
ইতিহাসে চিরন্তন সত্য কথা হচ্ছে, যুগ কখনও একই ধারায় প্রবাহিত হবে না। পরিবর্তন হবে। এটা অবশ্যম্ভাবী। জন্মের পর থেকে পৃথিবী এই গতিতেই এগিয়ে চলেছে। আজ অবধি চলছে, আগামীতেও চলবে। সেই পরিবর্তন মানুষের সমাজ, জীবন, রাষ্ট্র- সর্বক্ষেত্রেই বাস্তব। খেলাধুলা, বিশেষ করে বলতে গেলে ক্রিকেটও এর বাইরে নয়, কোনোভাবেই।
বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজ এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। গত দুই-তিন বছর যে সাফল্যের ধারাবাহিকতা, তা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পার হওয়ার পরই এ অবস্থানে এনে দাঁড়িয়েছে বাংলাে শের ক্রিকেট।
২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব থেকে মুশফিকুর রহীমকে সরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। এর আগেও মাশরাফি দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে; কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইনজুরি তাকে মাঠেই থাকতে দেয়নি। মাশরাফির পরিবর্তে, তখন নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তেছিল সাকিব আল হাসানের ঘাড়ে।
খুব মনে পড়ে, ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে ২২৮ রান করার পর বোলিংয়ে এসে ১ ওভার বল করতে পেরেছিলেন মাশরাফি। এরপরই তিনি ইনজুরিতে। দুই সতীর্থের কাঁধে ভর করে মাঠের বাইরে বাংলাদেশ অধিনায়ক।
সহ অধিনায়ক হিসেবে মাঠের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সাকিব আল হাসান। ভোজবাজির মত পাল্টে গেল পুরো মাঠের দৃশ্যপট। যে ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের আশা ছিল ক্ষীণ, সেই ম্যাচে ডি/এল মেথডে বাংলাদেশ জিতল ৯ রানে।
সিরিজের অবস্থা কী হয়েছিল? সবারই জানা। ৫ ম্যাচের সিরিজ এক ম্যাচ ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। বাকি চার ম্যাচেই কিউইদের হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ। বড় কোনো ক্রিকেট ন্যাশনের বিপক্ষে সেই তো প্রথম কোনো সিরিজ জয়! এলো সাকিব আল হাসানের হাত ধরে। যদিও তিনি তখন পূর্ণাঙ্গ অধিনায়ক নন। দায়িত্বপ্রাপ্ত।
এরপর সাকিবের অধীনে বেশ কয়েক বছর ক্রিকেট খেললো বাংলাদেশ। এমনকি ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপও খেলেছিল সাকিবের নেতৃত্বে। এরপর নানা বিতর্ক আর সমালোচনা সঙ্গী করে সাকিবকে সরে যেতে হলো নেতৃত্বের দায়িত্ব থেকে।
কিন্তু নেতা সাকিব না থাকলেও, পারফরমার সাকিবের ধারাবাহিকতা তুলনাহীন। তিনি নিয়মিত পারফরমার। অলরাউন্ডারদের তালিকায় সব সময়ই বিশ্বসেরা। বাংলাদেশের অনেকগুলো জয়ের রূপকার তিনি। মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের শেষভাগ থেকে বাংলাদেশ সাফল্যের মসৃন পথে যাত্রার মূল কান্ডারিই কিন্তু ছিলেন এই সাকিব আল হাসান।
মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৪ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়েকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে। এরপর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স। ইংল্যান্ডের মত দলকে বিদায় করে খেলেছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশের বিপক্ষে সিরিজ জয়।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মত দেশকে টেস্টে পরাজিত করা। শ্রীলঙ্কার মাটিতে টেস্ট জয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অসাধারণ সাফল্য। সর্বোপরি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কিংবা আইসিসি বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার কৃতিত্ব অর্জন- চাট্টিখানি কথা নয়। মাশরাফির নেতৃত্বে বলা যায় নতুন যুগের সূচনা করেছিল বাংলাদেশ।
মাশরাফির যুগ শেষ হতে চলল প্রায়। বয়স আর ইনজুরির সঙ্গে তিনি পেরে উঠছেন না। যে কারণে, শ্রীলঙ্কা সফরেই ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন তিনি। টেস্ট তো খেলছেন না সেই ২০০৯ সাল থেকে। ওয়ানডেও কতদিন খেলেন আর, তার কোনো ঠিক নেই। বলছেন, ২০১৯ বিশ্বকাপই শেষ। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ওয়ানডেতে মাশরাফি রয়েছেন আর দুই বছর।
তার বিদায়ের পর বাংলাদেশ দলের সাফল্যযাত্রা, এই দলের ঝাণ্ডা ধরে এগিয়ে নেবেন কে? বাংলাদেশ দলে কে আছেন এমন, যিনি এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন! সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে কেবলই সাকিব আল হাসানের মধ্যে। মাশরাফি টি-টোয়েন্টি দায়িত্ব ছাড়ার পর বোর্ড (বিসিবি) থেকে তড়িগড়ি করে এই ফরম্যাটের জন্য অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের নাম ঘোষণা করে দেয়।
গত এপ্রিলে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেলেও, প্রায় ৬ মাস পর গিয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছে সাকিব অ্যান্ড কোং। আজ রাতে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবর্তিত অধিনায়ক জেপি ডুমিনির সঙ্গে টস করতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অধিনায়ক সাকিবের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এই নেতৃত্বভার কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। কিংবা কারও ইনজুরির সুবাধে পাওয়া নয়। এই নেতৃত্বভার পুরোপুরি অরিজিন্যাল।
মাশরাফি যেভাবে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশকে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, সাকিবেরও সামনেও এখন সেই চ্যালেঞ্জ। অন্তত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশকে সে জায়াগায় নিয়ে আসার। এই একটি ফরম্যাটে এখনও বাংলাদেশ স্থিতি পেলো না। র্যাংকিংয়ে আফগানিস্তানের মত দলের পেছনে। এই ফরম্যাটে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব এখন সাকিবের কাঁধে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব এখন এমন একজনের কাঁধে, যিনি বিশ্বব্যাপি এই ফরম্যাটের ফেরিওয়ালা। আইপিএল, সিপিএল, পিএসএল, বিগ ব্যাশ থেকে শুরু করে অনেকগুলো বিদেশি ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্টের নিয়মিত পারফরমার সাকিব। তার জন্য আবার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এমন এক সময়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ দল রয়েছে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে সবচেয়ে বাজেভাবে হেরেছে বাংলাদেশ। সেই অবস্থা থেকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে সেই প্রোটিয়াদের বিপক্ষেই কেমন করবে বাংলাদেশ, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবুও আশা, সাকিব আল হাসানের মত নেতার হাত ধরে এই ফরম্যাটেও ধীরে ধীরে পরাশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে বাংলাদেশ।
আইএইচএস/আইআই