সাকিব-মিরাজরা বোঝালেন বাংলাদেশের স্পিনই সেরা
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর দু’দিন আগে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সাকিব আল হাসান দাবি করেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার স্পিনারদের চেয়ে বাংলাদেশের স্পিনাররাই সেরা। অস্ট্রেলিয়া দলে অনেক অভিজ্ঞ নাথান লিওন আছেন। সঙ্গে রয়েছেন অ্যাস্টন অ্যাগার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তবুও সাকিব নিজেদের স্পিনকে সেরা দাবি করলেন।
সাকিবের কথা শুনে হয়তো সমালোচকরা আড়ালে হেসেছেনও; কিন্তু সাকিব যে এমনি এমনি এই দাবিটা তোলেননি সেটা প্রমাণ করে দিলেন। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৬০ রানে অলআউট হয়ে গেলেও, অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশের স্পিনাররাই বেধে রাখলেন ২১৭ রানে। একটি রানআউট বাদ দিলে বাকি ৯টি উইকেটই দখল করেছেন বাংলাদেশের স্পিনাররা। তিন স্পিনার সাকিব, মিরাজ আর তাইজুল। প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের স্পিনই সেরা।
অথচ ম্যাচ শুরুর আগে সবার মনে সংশয় ছিল, শেরে বাংলার উইকেট কি আগের মতো স্পিন ফ্রেন্ডলি হবে? নাকি অতি বর্ষণে পেসারদের স্বর্গ হয়ে দেখা দেবে? উইকেট নিয়ে এমন সংশয় ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট শুরুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
যতই দামি ও মোটা পুরু কভারে ঢাকা থাকুক, শেরেবাংলার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যতই ভাল থাকুক আর চিফ কিওরেটর গামিনি ডি সিলভার হাতে যেমন পরিচর্যাই হোক না কেন- এবার বৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশি। যে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই উইকেটের নিচের স্তরে পানি আছে।
কাজেই উইকেটের চরিত্র নিয়ে সংশয় জাগা স্বাভাবিক। সে সংশয়ে ঘি ঢেলে দিয়েছিলেন টাইগার অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমও। টেস্ট শুরুর ২৪ ঘন্টা আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘শেরে বাংলার উইকেট সম্পর্কে এবার আগাম মন্তব্য করা কঠিন।’
শেষ পর্যন্ত সে সংশয় কেটে গেছে। প্রথম দিনই জানা হয়ে গেছে, উইকেট আগের মতই- মানে স্পিন উপযোগীই আছে। বোলারদের বুটের স্পাইকে প্রথম দিনই পপিং ক্রিজের আশপাশে বেশ কিছু জায়গায় ক্ষত তৈরি হয়েছে।
সেই ক্ষত যেখানে একটু বেশি, যে সব জায়গায় মাটি সরেছে বেশি। সেখানে বল পড়ে কখনো স্বাভাবিকের চেয়ে লাফিয়ে উঠেছে। আবার কোন কোনো সময় বিপজ্জনকভাবে নিচুও হয়েছে। আর তাতেই প্রথম দিনের প্রথম দুই ঘণ্টা ছাড়া গত দুই দিনে স্পিনারদের প্রচণ্ড ও দোর্দণ্ড প্রতাপের মুখে ব্যাটসম্যানরা।
শেরে বাংলার উইকেটে এ টেস্ট যে লো স্কোরিং হয়েছে, সেটা যতটা দুই দলের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়, তার চেয়ে বেশি দু’দলের স্পিনারদের ঘূর্ণি বলে। রোববার প্রথমদিন পতন ঘটা ১৩ উইকেটের নয়টিই জমা পড়েছিল স্পিনারদের ঝুলিতে।
যার মধ্যে তিন অজি স্পিনার নাথান লিওন ও অ্যাস্টন অ্যাগার সমান তিনটি করে ও অনিয়মিত অফ স্পিনার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল একটি উইকেট দখল করেন। বাংলাদেশের দুই স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাকিব একটি করে উইকেট ভাগ করে নেন।
আজ অস্ট্রেলিয়ার যে সাত উইকেটের পতন ঘটে তার চারটি জমা পড়ে সাকিবের পকেটে। আর মিরাজ পান দুটি। অপর একটি উইকেট দখল করেন বাঁ-হাতি স্পিনার তাইজুল। মোদ্দা কথা, ব্যাট ও বলের লড়াইয়ে বোলারদের মানে স্পিনারদের প্রাধান্য পরিষ্কার।
প্রথম দিন খেলা শেষে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, ‘আমাদের এখন দুইটা কাজ। এক, যতটা সম্ভব ভাল জায়গায় বল ফেলা। আর অস্ট্রেলিয়াকে যত কম রানে অলআউট করা- প্রথম দিন খেলা শেষে এমন কথাই বলেছিলেন সাকিব আল হাসান।
তার কথা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের বোলার তথা স্পিনাররা। সাকিব নিজে এ মিশনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাই ৫ উইকেট দখল করেন সাকিব। একটি রান আউট। অন্য চার উইকেটের তিনটি পেয়েছেন অফ স্পিনার মিরাজ। অন্যটি বাঁ-হাতি তাইজুলের।
আগের দিন অজি নাইটওয়াচম্যান নাথান লিওনকে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলা সাকিব আজ দ্বিতীয় দিন আরও চার উইকেটের পতন ঘটান।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, গত বছর অক্টোবরে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ১০৮ রানের অবিস্মরনীয় জয়ের রূপকার ছিলেন স্পিনাররা। ইংলিশদের ২০ উইকেটের সবগুলোর পতন ঘটান বাংলাদেশের তিন স্পিনার মেহেদী হাসাস মিরাজ, সাকিব আল হাসান ও তাইজুল ইসলাম।
এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৯ উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন ওই তিন স্পিনার। সাকিব ৬৮ রানে সর্বাধিক ৫টি, অফস্পিনার মিরাজ ৬২ রানে তিনটি ও তাইজুল ৩২ রানে এক উইকেটের পতন ঘটান।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের স্পিনাররা ভাল বল করেছেন। অজি ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে সর্বাধিক সমীহ আদায়ের পাশাপাশি উইকেটও আদায় করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের স্পিনাররা দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করেছেন।
সারা দিন ভাল জায়গায় বল ফেলার চেষ্টা ছিল। তিন স্পিনারের একজনও আলগা বল করেননি। যতটা সম্ভব টাইট লেন্থে বল ফেলে টার্ন করিয়েছেন। তাদের ভালই জানা, ভাল জায়গায় বল ফেলে টার্ন করাতে পারলে সাফল্য নিশ্চিত।
ভাল জায়গা বলতে বাংলাদেশের স্পিনার বেছে নেন বোলারদের বুটের স্পাইকে ক্ষত-বিক্ষত জায়গাকে। শেরেবাংলার যে উইকেটে খেলা হয়েছে, তার দু’দিকের বোলিং মার্কের আশ পাশে বোলারদের স্পাইকে মাটিতে ক্ষত তৈরি হয়েছে।
সেই জায়গাগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে কালোও হয়ে গেছে। ওই জায়গায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেখানে বল পড়ায় স্বভাবিকের চেয়ে একটু বেশি টার্ন হয়েছে। আর ভাঙ্গা যেখানে বেশি, সেখানে বল পড়ে কিছু ডেলিভারি স্বাভাবিকের চেয়ে লাফিয়েও উঠেছে বেশি।
এছাড়া কখনো কখনো ফ্লাইটেও অসি ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করেছেন মিরাজ ও সাকিব। আজ যে দু’জনার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া, সেই অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ ও মিডল অর্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল- দু’জনই ফ্লাইটে পরাস্ত হয়েছেন।
প্রথম ফ্লাইটে আক্রমণাত্মক শটস খেলতে গিয়ে বোল্ড হন অসি অধিনায়ক। রাউন্ড দ্য উইকেটে বল করা মেহেদী হাসান মিরাজের ফ্লাইটেড ডেলিভারিকে সামনের পায়ে ভর করে আক্রমণাত্মক শট খেলতে যান স্মিথ। লেগ মিডলে পিচ পড়া ডেলিভারি স্মিথের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দেয়।
এরপর বাঁ-হাতি সাকিবের ফ্লাইটের ফাঁদে পড়েন ম্যাক্সওয়েল। এ আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান তার বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে যতটা সম্ভব হাফ ভলিতে খেলতে পারেন- এই ভেবে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ফ্লাইটেড ডেলিভারি দেন সাকিব।
উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে তা হাফ ভলিতে খেলার চেষ্টা করেন ম্যাক্সওয়েল। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি টার্ন করে ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল চলে যায় কিপার মুশফিকের গ্লাভসে। এগিয়ে যাওয়া ম্যাক্সওয়েল ফেরার আগেই উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন মুশফিক।
এআরবি/আইএইচএস/এমএস