চার নম্বর নিয়ে আর কত পরীক্ষা
যে ভাবেই হোক, সুযোগ যখন পেয়েছেন- তখন তাকে খেলানো হবে। দেখবেন ঠিক ১১ জনে জায়গা পাবেন মুমিনুল হক। ভক্ত-সমর্থকরা এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাল সারা দিন আর আজ সকালে যত জন তার পছন্দের একাদশ সাজিয়েছেন, তার সবগুলোতেই ছিলেন মুমিনুল।
শুধু ভক্ত ও সমর্থকদের কথাই বা বলা কেন? ক্রিকেট বোঝেন, বাংলাদেশ দলের খেলা দেখেন এবং জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের খুঁটিনাটি যাদের নখদর্পনে- তাদের বড় অংশের ধারণা ছিল নাসিরকে খেলানো হতে পারে। তারা নিশ্চয়ই ভক্ত ও সমর্থকদের মত আবেগতাড়িত হয়ে অন্ধ ভালবাসা থেকে মুমিনুলকে খেলানোর দাবিতে সোচ্চার ছিলেন না!
সচেতন ক্রিকেট অনুরাগীরা একটি বোধ-বিশ্বাস থেকেই মুমিনুলকে দলে পেতে চেয়েছেন। তাদের ধারণা ছিল, চার নম্বর পজিশনের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা ভালোমত সামলাতে পারতেন মুমিনুল। এ বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান দলে থাকলে চার নম্বর পজিশনে একজন যথার্থ ও পরিণত পারফরমার পেত দল।
কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট তা ভাবলো কই? টিম ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ করে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কোনোভাবেই চাননি মুমিনুল এ সিরিজে খেলুক। সে কারণেই তার ১৪ জনে জায়গা হয়নি। মোসাদ্দেকের চোখের সমস্যা না হলে মুমিনুল নিশ্চিতভাবেই প্রথম টেস্ট স্কোয়াডের বাইরে থাকতেন। সেই মুমিনুল মোসাদ্দেকের অসুস্থতার কারণে স্কোয়াডে ফিরলেও টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত বদলায়নি একটুও।
আর তাই মমিনুলকে বাইরে রেখে একাদশ সাজানো। আর চার নম্বরে সাব্বির রহমান রুম্মনকে খেলানো। সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সাব্বিরকে চার নম্বরে নামানোর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল সেটা তো প্রমাণ হয়ে গেছে।
সাব্বির তার ক্যারিয়ারে একটি মাত্র টেস্টে চার নম্বরে খেলেছেন। সেটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোর পি সারা স্টেডিয়ামে শততম টেস্টে। ওই ম্যাচের উভয় ইনিংসে চল্লিশের ঘরে (৪২+৪১) রান করায় হয়ত কোচের আস্থা বেড়ে থাকবে তার ওপর। আর সে কারণেই হয়ত আজ চার নম্বরে সাব্বিরকে খেলানো।
সাব্বির কিছুই করতে পারেননি। ফিরে গেছেন শূন্য রানে এবং প্রথম বলে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে। সাব্বির চরম ব্যর্থ হয়ে সাজঘরে পা বাড়াবার মুহূর্ত থেকে সবার মনে একটিই প্রশ্ন, কেন সাব্বিরকে চার নম্বরের মত গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে খেলানো হলো?
সবার জানা, চার নম্বরে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক। এই পজিশনে বাঁ-হাতি মুমিনুলের ট্র্যাক রেকর্ড দারুণ। ৯ টেস্টে তিন শতক ও পাঁচ অর্ধশতকসহ তার সংগ্রহ ৮৭৭ রান। গড়ও সবার চেয়ে বেশি, ৬২.৬৪ করে। তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটিও (১৮১ চার নম্বরেই)।
সেই মমিনুল যখন ১১ জনের বাইরে, তখন অধিনায়ক মুশফিক চার নম্বরে ব্যাট করতে নামতে পারতেন। যদিও বাংলাদেশ অধিনায়ক টেস্টে চারে খেলেছেন কম; দুটি মাত্র টেস্ট। তিন ইনিংসে রান সাকুল্যে ১২১। গড় ৪০.৩৩। পঞ্চাশ একটি। সর্বাচ্চ ৮৫।
শেষ চারে ব্যাট করেছেন ২০১৭ সালের মার্চে, গলে। সিরিজের প্রথম টেস্টে চারে নেমে যথাক্রমে ৮৫ ও ৩৪ রান করেন মুশফিক। ওই টেস্টে কিপিং করেন লিটন দাস।
এছাড়া ২০১৫ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে ফতুল্লায় প্রথম টেস্টে চার নম্বরে ব্যাট করেন মুশফিক। বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত সে ম্যাচে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংই করতে পারেননি। প্রথমবার আউট হয়ে গিয়েছিলেন মাত্র ২ রান করে।
বাংলাদেশ প্রথমে ফিল্ডিং করলে মুশফিকের চার নম্বরে ব্যাটিং না করা নিয়ে কথা উঠতো না। তখন সবাই বলতেন, অনেকটা সময় ধরে উইকেটের পেছনে কাটিয়েছেন, তাকে চার নম্বরে না খেলানোই ঠিক ছিল।
কিন্তু আজ তো আর মুশফিক কিপিং করেননি। টস জিতে ব্যাটিং বেছে নিয়েছেন। তাই আজ টাইগার অধিনায়কের চার নম্বরে নামার ক্ষেত্রে কোনই সমস্যা ছিল না। মুশফিক ইচ্ছে করলেই চার নম্বরে ব্যাট করতে নামতে পারতেন। তাহলে ব্যাটিং অর্ডারে ভারসাম্যটা হয়তো চলে আসতো।
কারণ, আজ তো আর তাকে ক্লান্তি ও অবসাদ গ্রাস করেনি। বরং একদম সতেজ ও সজিব ছিলেন মুশফিক। অনায়াসে চার নম্বরে তাকে খেলানো যেত। কিপিং না করে আগে ব্যাটিংয়ে নামার এই সুযোগটা অধিনায়ক নিজেই হাতছাড়া করলেন।
মুশফিক কোচ তথা টিম ম্যানেজমেন্টের আগে থেকে ঠিক করে রাখা পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। মানা গেল আগে থেকে স্থির করা ছিল চার নম্বরে খেলবেন সাব্বির। অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিং করলে সাব্বিরকে চারে খেলানো হলে হয়ত একটি কথাও উঠতো না; কিন্তু তা যখন হয়নি। তখন কেন মুশফিক সিদ্ধান্ত পাল্টে চারে নামলেন না ?
টিম মিটিংয়েই হয়তো আগে থেকে সেট করা ছিল- মুশফিক কিপিং করবেন, তাই চার নম্বরে খেলানো হবে সাব্বিরকে। এটা তো হলো প্ল্যান ‘এ’; কিন্তু প্ল্যান ‘বি’-তে তাহলে কি ছিল? নাকি প্ল্যান ‘বি’ই নেই। যে চক আগে থেকে তৈরি করা, সে মতেই চলতে হবে! তার নড়চড় করা যাবে না মোটেও? পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তড়িৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহসও তাহলে নেই কারও?
টেস্ট ক্রিকেট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রং বদলায়। এক সেশন থেকে আরেক সেশনে পাল্টে যায় চালচিত্র। সেখানে আগে থেকে ঠিক করে রাখা লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা কতটা? পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা বদলানো যায়, লক্ষ্য ও কৌশল পাল্টে ভিন্ন পথে হাঁটা যায়- সেই চর্চাটা এখনো তৈরি হয়নি বাংলাদেশ শিবিরে।
নাকি এটাও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কোনো গেম প্ল্যান? মুশফিক আগে কিপিং করুক বা না’ই করুক, চার নম্বরে খেলবে সাব্বির। সন্দেহ নেই সাব্বির এ মুহুর্তে দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটিং প্রতিভা। প্রচন্ড সাহসী উইলোবাজ। ভয়-ডর নেই। দারুন স্ট্রোক মেকার। উইকেটের চারিদিকে শটস খেলতে পারেন। যার মেধা ও প্রজ্ঞা নিয়ে সংশয় নেই কারোরই; কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের মত আসরে, যেখানে ধৈর্য্য ও সংযমী ব্যাটিংটাই মূল, সেখানে সাব্বিরের আগ্রাসী ও আক্রমনাত্মক ব্যাটিংয়ের কার্যকরিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বেরিয়ে আসবে টেস্ট ক্রিকেটে চার নম্বর পজিশনে কারা ব্যাট করেন। বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সেরা ও সফল উইলোবাজের তালিকায় যারা ওপরের দিকে, সেই বিরাট কোহলি, জো রুট, কেন উইলিয়মসন ও স্টিভেন স্মিথ বেশিরভাগ সময় চার নম্বরেই ব্যাট করেন।
সেখানে বাংলাদেশের হয়ে মুশফিক কিংবা সাকিব হতে পারতেন ওই পজিশনে সম্ভাব্য সেরা বিকল্প। সাব্বিরকে খেলানোর বদলে অধিনায়ক মুশফিক কিংবা সাকিবকেও খেলানো যেত। সাকিব যেহেতু পাঁচ কিংবা ছয় নম্বরে খেলেন, তাকে চারে খেলানো যেতেই পারে। আজ পাঁচ নম্বরে নেমে সাকিব যে দারুন ব্যাটিং করেছেন, তা দলের ভরাডুবি এড়াতে রেখেছে বড় ভূমিকা।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম