ওপেনিংয়ে ইমরুল কেন তামিমের সঙ্গী নন?
‘আচ্ছা বলুন তো টেস্টে উদ্বোধনী জুটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ কার কার?’ পরিসংখ্যান নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তারা এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বলে উঠবেন, কেন তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েসের!
হ্যাঁ সত্যিই তাই। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম উইকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বড় জুটিটি তামিম ও ইমরুলের। তাও খুব বেশিদিন আগে নয়, ২০১৫ সালের এপ্রিলে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে ওই দুই বাঁ-হাতি ওপেনার ৩১২ রানের জুুটি গড়েছিলেন।
সেটাই এখন পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ। শুধু সেই রেকর্ড পার্টনারশিপের রচয়িতা বলেই নয়, প্রথম উইকেটে তামিম-ইমরুলের কৃতিত্ব ও অর্জন অনেক। ইতিহাস ও পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড ধরলে তামিম ও ইমরুলই টেস্টে বাংলাদেশের সেরা উদ্বোধনী জুটি।
কারণ, প্রথম উইকেটে সবচেয়ে বেশি রানের পার্টনারশিপের স্রষ্টা তামিম-ইমরুলের উদ্বোধনী জুটিতে আরও একজোড়া বড় সাফল্য, অর্জন ও কৃতিত্ব আছে। টেস্টে প্রথম উইকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় (২২৪, ২০১৪ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে) ও তৃতীয় সর্বাধিক ১৮৫ রানের (২০১০ সালের মে মাসে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে) পার্টনারশিপটাও এ দুই বাঁ-হাতি ওপেনারের।
সেটাই শেষ নয়। দু’জনার আরও একটি শতরানের জুটি (১২৬, ২০১০ সালের জুনে ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে)। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতগুলো বড় পার্টনারশিপ আর নেই কোন জুটির। সব ফরম্যাটে যিনি এরই মধ্যে নিজেকে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সন্দেহাতীতভাবেই যিনি বাংলাদেশের এক নম্বর ওপেনার- সেই তামিম ইকবালও ইমরুল কায়েসকেই তার সেরা সঙ্গী মনে করেন।
দুই বছর আগে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রেকর্ড ৩১২ রানের জুটি গড়ার পর তামিম বলেছিলেন, ইমরুল কায়েসের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া দারুণ। আমরা একজন আরেকজনকে ভাল বুঝি। আমাদের সমঝোতাও চমৎকার। দু’জন দু’জনকে চিনি। জানি। বুঝি। কে কখন কি করবে? তাও ভাল জানা। মোট কথা, আমাদের রসায়নটাও ভাল।’
তাই পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড ধরলে তামিম ও ইমরুলই টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ও সেরা উদ্বোধনী জুটি।
এমন স্বার্থক ও সফল জুটির স্রষ্টা যারা, সেই তামিম ও ইমরুল এখনো ঠিক দলে আছেন; কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তারা দু’জন ইনিংসের সূচনা করবেন না। ওপেনিং জুটিতে ইমরুল নন, তামিম ইকবালের সঙ্গী হবেন সৌম্য সরকার। ইমরুলের ব্যাটিং পজিশন তিন নম্বর।
আজ (মঙ্গলবার) শেরেবাংলায় অনুশীলনের পর মিডিয়ার সামনে ইমরুল নিজেই সে কথা জানিয়ে গেলেন। এমন নয়, ইমরুল এর আগে কখনো তিনে খেলেননি। খেলেছেন। গত মার্চে কলম্বোর পি সারা ওভালে শততম টেস্টে তামিম ও সৌম্যই ইনিংসের সূচনা করেছেন। ইমরুল ওয়ানডাউনে নেমে ব্যাট করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? ইমরুল দলের বাইরে থাকলে একটি কথাও হতো না; কিন্তু তিনি ১৪ জনের স্কোয়াডে। তাকে তিন নম্বরে ধরে টিম কম্বিনশনও প্রায় চূড়ান্ত। তখনই প্রশ্ন জাগে। কথা ওঠে- এমন সফল, স্বার্থক ও কার্যকর উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গা হচ্ছে কেন?
তামিম ও ইমরুল ইনিংসের সূচনা করলে ক্ষতি কি? ইমরুলকে তিন নম্বরে খেলানোর যৌক্তিকতাই বা কি? শুধু পরিসংখ্যানের আলোকেই যে তামিমের সঙ্গী হিসেবে ইমরুল প্রথম পছন্দ, তা নয়। আসলে ব্যাটিং শৈলী, টেম্পারামেন্ট ও অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনের কথা চিন্তা করলেও ওপেনার হিসেবে টেস্টে ইমরুল হতে পারেন তামিম ইকবালের যোগ্য সঙ্গী।
ইমরুলের ব্যাটিং শৈলীটাই সবচেয়ে টেস্ট উপযোগী। তার অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনও দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাটের সাথে লাগসই। বাংলাদেশের দুই শীর্ষ স্থানীয় ক্রিকেট কোচ সারোয়ার ইমরান ও মোহাম্মদ সালাউদ্দীন টেস্টে তামিম ইকবালের সঙ্গী হিসেবে ইমরুলকেই বেছে নিতে চান। দু’জনারই মত- ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট হলে সৌম্য সরকার ফার্স্ট চয়েজ হতেন; কিন্তু যেহেতু খেলাটা টেস্ট, এখানে আক্রমণাত্মক উইলোবাজির চেয়ে রয়ে সয়ে খেলা, বলের মেধা ও গুণ বিচার করে দীর্ঘ সময় উইকেটে থাকাই প্রথম কথা- সেখানে সমসাময়িক যে কারো চেয়ে ইমরুলই এগিয়ে।
আজ সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সাথে আলাপে দেশ প্রসিদ্ধ কোচ সারোয়ার ইমরান বলেন, ‘ইমরুল লম্বা ইনিংস খেলার জন্য অনেক বেশি কার্যকর। সৌম্য সরকারও ভাল ব্যাটসম্যান। মেধা ও সামর্থ্যে ঘাটতি নেই এতটুকু। তবে তার ব্যাটিং শৈলীটা ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির জন্য বেশি কার্যকর; কিন্তু টেস্টে ইমরুল বেটার চয়েজ। দীর্ঘ ইনিংস খেলার মানসিকতা আছে। ধৈর্য-সংযমও বেশি। আর সবচেয়ে বড় কথা ইমরুলের ব্যাটিং শৈলীটাই টেস্ট উপযোগী। তাই তামিম ইকবালের সঙ্গী হিসেবে আমার প্রথম পছন্দ ইমরুল।’
আরেক কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দীনও তাই মনে করেন। তার ব্যাখ্যা, ইমরুল অভিজ্ঞ। দীর্ঘ দিন ধরে ইনিংস ওপেন করছে। তামিম ইকবালের সাথে ইমরুলের রেকর্ডও ভাল। সৌম্যকেও অনেক পছন্দ করি। তার সামর্থ্যও কম নয়। তারপরও আমি মনে করি ইমরুলের দীর্ঘ ইনিংস খেলার মানসিকতা বেশি।’
সালাউদ্দীন আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। তার অনুভব ও উপলব্দি, ‘অস্ট্রেলিয়ানরা অনেক ভেবে-চিন্তে এবার স্পিন ডিপার্টমেন্টটা অনেক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও ধারালো করে এসেছে। কাজেই আমাদের ব্যাটসম্যানদের অজি ফাস্ট বোলিংয়ের পাশাপাশি স্পিন আক্রমণও মোকাবেলা করতে হবে। ইমরুল স্পিনে ভাল খেলে। স্পিনে সৌম্যর চেয়ে বেটার ব্যাটসম্যান ইমরুল।’
ইতিহাস-পরিসংখ্যানে যিনি এগিয়ে, সারোয়ার ইমরান ও সালাউদ্দীনের মত দেশ বরেণ্য প্রশিক্ষকও যাকে তামিমের আদর্শ সঙ্গী মনে করেন- সেই ইমরুলকে ওপেনিং থেকে সরিয়ে তিন নম্বওে খেলাচ্ছেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
কেন, কি কারণে? তার ব্যাখ্যা দেননি এখনো। নিশ্চয়ই তারও একটা যুক্তি আছে। তবে খালি চোখে মনে হচ্ছে, মমিনুলকে আড়ালে ঠেলে দেয়ার জন্য তিন নম্বর পজিশনে ইমরুলকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
তিন নম্বর পজিশনে মমিনুল বেস্ট অপশন। সেখানে ইমরুলও তার চেয়ে পিছিয়ে; কিন্তু যেহেতু ইমরুল ওপেন করবেন না, তাই তাকে নিচে নামিয়ে দেয়া। আর তাতেই মমিনুলের টেস্ট একাদশে জায়গা হারিয়ে ফেলা নিশ্চিত হয়ে যাবে। ১৪ জনের দলে বাধ্য হয়ে নিতে হলেও এ ক্ষেত্রে জিতে যাবেন হাথুরুসিংহে!
এআরবি/আইএইচএস/আইআই