ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

জবি ছাত্রলীগ: কুকর্মে জড়ালেও ব্যবস্থা নেয় না কেউ

প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলাদেশের প্রায় সবকটি আন্দোলনের সঙ্গেই মিশে আছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা বাস্তবায়ন, ‘৬৯ -এর গণ-অভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ।

কিন্তু ছাত্রলীগের এই বীরত্ব গাঁথা বারবার ঢেকেছে এই সংগঠনেরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখার কুকর্মে। মূলত এই শাখার বর্তমান কমিটির সভাপতি এফএম শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক এসএম সিরাজুল ইসলামের সময়টাতেই বারবার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে খবরের শিরোনাম হতে হয়েছে জবি ছাত্রলীগকে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি ছাত্রলীগের এ ইউনিটের বিরুদ্ধে।  

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ সাবেক নেতাদের পকেটে যায় বলে বহু বিতর্কিত এ শাখা কমিটির নেতারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে।  

সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান জবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এফএম শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক এসএম সিরাজুল ইসলাম আগে কোনো নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাকতালীয়ভাবে এ শাখার নেতৃত্ব আসেন। এরপর দেখা যায় সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ড লিপ্ত হতে থাকেন শরীফুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম। তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা হয়ে ওঠেন এলাকার ত্রাস।

পুরান ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজের সাথে সখ্যাতা গড়ে তোলেন শরীফ-সিরাজ। শরীফুল ইসলাম কাজী ফিরোজ রশীদের সুদৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন জবির উদ্ধারকৃত নজরুল হলের বিনিময় করার অচেষ্টার মধ্য দিয়ে। শাখা জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও ছাত্রলীগ জবি শাখার সহ-সভাপতি হিমেলুর রহমানের প্রতিরোধের কারণে হলটি এখনো জবি শিক্ষার্থীদের দখলে রয়েছে। কাজী ফিরোজ রশিদ শরীফুল ইসলামকে গেন্ডারিয়ার ফজলুল হক মহিলা কলেজের গভর্নিং বর্ডির সদস্য করে দেন। সেখানেও তিনি শুরু করেন স্বেচ্ছাচারিতা। প্রভাব খাটিয়ে নিজের এক নিকট আত্মীয়কে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন শরীফ। অভিযোগ রয়েছে, এই কলেজে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সঙ্গে জোট বেধে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করছেন তারা।  
 
প্রভাব খাটাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অশোক তরু সাহার বিরুদ্ধে কাজ করতেও শুরু করেন শরীফুল ইসলাম। অশোক তরুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে শরীফুল ইসলাম স্থানীয় ও তার পালিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে মহিলা কলেজেটিতে মাদক সেবনের কেন্দ্র বসতে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন খোদ কলেজটির শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বেশ ক্ষোভ বিরাজ করছে মহিলা কলেজটিতে। সর্বশেষ কলেজটির শিক্ষার্থীরা ১৯ জানুয়ারি ‘ফজলুল হক মহিলা কলেজ সচেতন ছাত্রী পরিষদ’র ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন।  

মানববন্ধনে তারা ফজলুল হক মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অশোক কুমার সাহাকে স্বপদে পুনর্বহাল, বহিরাগতদের দিয়ে শিক্ষক-ছাত্রীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং শরীফুলের পালিত বহিরাগত বখাটেদের দ্বারা ছাত্রীদের সম্মানহানির বিচারের দাবি জানানো হয়।

শরীফুল ইসলামের জামায়াতপ্রীতি এর আগেও প্রকাশ পেয়েছির তার কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময়ে। সে সময় লক্ষীপুর উপজেলা জামায়াতের রোকনের ছেলে শিবির ক্যাডার জুনায়েত হোসেনকে ছাত্রলীগ জবি শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে আসীন করেন তিনি। এ নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে জুনায়েতকে জবি সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ করিয়ে দেন।

অন্যদিকে শাখা সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বাংলাবাজারের আল বারাকা প্রকাশনীতে চাঁদা আদায়ের সময় তা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। সেই ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এ নিয়ে  রাজনীতিপাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়। ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ রসায়ন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলমের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে পাঁচ লাখ টাকার টেন্ডার ছিনিয়ে নেয়া হয় সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে। এ নিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পরে সিরাজকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য আন্দোলনে নামে জবি শিক্ষক সমিতি। কিন্তু ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এছাড়া সিরাজ জবি প্রক্টর অফিসে বসে পুরান ঢাকার এক যৌনকর্মীর কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের রেকর্ডিং প্রকাশ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নিয়ে চলে নানা আলোচনা। ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় সিরাজ ওই চাঁদার টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন।

এছাড়া, শরিফুল ও সিরাজুল জবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পরপরই ঘটে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা- বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার জজকোর্টের সামনে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী মিছিল থেকে নির্মমভাবে কোপানো হয় পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে। বিষয়টি স্থানীয় ও বিশ্ব গণমাধ্যমে গড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা। এছাড়া গত তিনবছরে আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজির ঘটনায় অর্ধশতাধিকবার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে জবি ছাত্রলীগ।

তাছাড়া সম্প্রতি তাদের চাপাচাপিতে জবি সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। এ সংবাদ প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সকল প্রকার নিয়োগ স্থগিত করতে বলে। এতেও টনক নড়েনি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের।
 
গত ৩০ জানুয়ারি মুঠোফোনে এসব অভিযোগের বিষয়ে জাগোনিউজের পক্ষ থেকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এফএম শরিফুল ইসলামের কাছ জানতে চাওয়া হলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কে? তুমি সরকারের লোক বা পুলিশ-টুলিশ, ওসি-টোসি?’

গণমাধ্যমের তথ্য চাওয়ার বিষয় মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘তোমার গণমাধ্যমের নিয়ম...আমার নিয়ম শুনো, তুমি আমার সামনে আসো।’

অভিযোগের কথা বললে শরিফুল বলেন, ‘তোমার কাছে অভিযোগ দিবে ক্যা?’ তুমি কী? অভিযোগ দেয় থানার পুলিশের কাছে। তোমার নিয়ম কি বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা? কে অভিযোগ দিয়েছে? আপনার কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিয়েছে? আপনি কি সরকারের লোক, পুলিশ যে আপনার কাছে অভিযোগ করেছে।’

কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি আরো বলেন, ‘আপনার যা যা অভিযোগ তা লিখিত আকারে নিয়ে আসেন। আমি জবি ছাত্রলীগ সভাপতি। আপনি গণমাধ্যম কর্মী। আপনি জবিতে এসে সরাসরি অভিযোগুলো নিয়ে আসেন।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাধারণ সম্পাদক এসএম সিরাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।  

সার্বিক বিষয়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ জাগোনিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কর্তৃপক্ষ জানেন। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে যতগুলো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে তার সবকটির ব্যবস্থা নিয়েছের কেন্দ্রীয় নেতারা।

এনএফ/এমএস