ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

আতঙ্ক নেই আছে কৌতূহল

প্রকাশিত: ০৫:০৪ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শেরপুরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে সীমান্তবর্তী জনপদে দফায় দফায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। কিছু দিন পর পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় জনমনে তেমন কোনো আতঙ্ক নেই আছে কেবলই কৌতূহল।

গত সোমবার ভোর ৩টা থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত (১-২ ফেব্রুয়ারি) নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা সীমান্তের কালাপানি গ্রামের চেংবান্দা পাহাড়ি টিলায় র‌্যাবের অভিযানে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলাসহ ৪৮ হাজার ২৫৭টি গুলি ও বিভিন্ন ধরনের ৬০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এসব গুলির মধ্যে বিমান বিধ্বংসী কামানের গুলি, মেশিনগান, পিস্তল ও বিভিন্ন ধরনের রাইফেলের গুলি রয়েছে। রয়েছে হেভি মেশিনগান, মেশিনগানের স্পেয়ার ব্যারেল,স্পাইপার রাইফেল, একে-৫৬ রাইফেলসহ ভারী অস্ত্রও। এছাড়া সামরিক কাজে ব্যবহার করা হয় এমন সব যোগাযোগ সরঞ্জামাদি। এর আগেও সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী এবং শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ি জনপদের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কয়েক বার বড় ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারূদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।

এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কোন আতঙ্ক নেই বলে নালিতাবাড়ী সীমান্তের বুরুঙ্গা, কালাপানি, মধুটিলা, বারোমারি এবং ঝিনাইগাতী সীমান্তের গজনী, বাঁকাকুড়া, গান্ধীগাঁও, গোমড়া, ছোট গজনী, পানবর এলাকার আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে তারা এ গুলি-অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

Sherpur

এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুরে (৪ ফেব্রুয়ারি) বুরুঙ্গা-কালাপানি এলাকার অস্ত্র-গুলি উদ্ধারের ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটি ঘিরে র‌্যাব-১৪ এর টহল অব্যাহত রয়েছে। তবে গরু রাখালরা কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে পাহাড়ে গরু চড়ানোর কাজে যেতে শুরু করেছেন। আশপাশের ধানক্ষেতে কৃষকরা বোরো রোপণেও মাঠে নেমেছেন। অস্ত্র-গুলি উদ্ধারের স্থানটি দেখতে উৎসুক কয়েকজনকে সীমান্ত সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নালিতাবাড়ী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আরিফ হোসেন জানান, তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদের আইটেমের কিছু আলামত রেখে সব অস্ত্র-গোলা বারুদ ঢাকার সেনা অর্ডিন্যান্স ডিপোতে পাঠানো হয়েছে। গুলির প্যাকেটে ইংরেজিতে ‘মেড ইন চায়না’ লেখা বলেও তিনি জানিয়েছেন।

নালিতাবাড়ীর বুরুঙ্গা সীমান্তে উদ্ধারকৃত গুলি ও অস্ত্র কাদের হতে পারে এমন প্রশ্নে র‌্যাব কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। র‌্যাব এবং পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এসব গুলি-অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ঘটনাটি তদন্তের পর কারা, কি উদ্দেশ্যে, কেন এসব গোরাবারুদ-অস্ত্র রেখেছিল এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

তবে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, নালিতাবাড়ী সীমান্তে উদ্ধারকৃত অস্ত্র-গুলি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হতে পারে। বর্তমান সরকারের তাড়া খেয়ে তারা এসব অস্ত্র-গুলি ফেলে পালিয়ে যেতে পারে।

স্থানীয় অধিবাসীদেরও ধারণা এমনই। তারা বলছেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার ও গোলাবারুদ উদ্ধার অভিযানে শেরপুরের প্রায় ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তবর্তী এলাকাটি উলফা শূন্য হয়ে পড়লেও তাদের রেখে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ এখনো বের হচ্ছে। বর্তমান সরকার পাহাড়ে উলফাদের ঘাঁটি তছনছ করে দেয়ার পর উলফার নেতৃত্ব পর্যায়ের প্রায় সবাই গ্রেফতার হওয়ায় সাধারণ সদস্যরা গা-ঢাকা দিয়েছে।

Sherpur

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এর আগেও নালিতাবাড়ী সীমান্তে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০০৭ সালের ১ মার্চ বুরুঙ্গা গ্রাম থেকে ভারী মেশিনগান, গুলি ও বিশেষ ডেটোনেটরসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের ৯ অক্টোবর নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া এলাকা থেকে বিজিবি (তৎকালীণ বিডিআর) ওয়াকিটকি, সৈন্যদের পোশাক ও সামরিক সরঞ্জামসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছিল। সে বছরই সেখানকার তানোর গ্রাম থেকে ১টি আর্জেস গ্রেনেড, ১টি অত্যাধুনিক পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়। সে সময় বুরুঙ্গা থেকে গ্রেফতার হওয়া ৬ জনই ভারতীয় নাগরিক ও আদালতে নিজেদের ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনডিএফবিএল (ন্যাশানাল ডেমোক্রেটি ফ্রন্ট অফ বোরোল্যান্ড) সদস্য বলে দাবি করেছিল।

অপরদিকে, রামচন্দ্রকুড়ায় গ্রেফতার হওয়া ৪ জন ভারতীয় নাগরিক এবং নিজেদের ‘উলফার টেররিস্ট’ বলে দাবি করেছিল। সীমান্তবর্তী পানিহাটা গ্রাম থেকে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি ২০ রাউন্ড গুলিসহ একটি একে-৪৭ চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করে পুলিশ।

২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) অভিযান চালিয়ে ঝিনাইগাতীর বাকাকুড়া এলাকা থেকে ড্রামভর্তি ২৯ হাজার ১০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। এর তিনদিন পর গজনী এলাকা থেকে আরও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। সে সময় কথিত রাসেল সাংমা নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নিজেকে ভারতীয় নাগরিক এবং আসামের বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন উলফার সদস্য বলে দাবি করেছিল। ওই ঘটনায় দায়ের করা অস্ত্র মামলায় আদালতে রাসেল সাংমার ১০ বছরের সাজা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শ্রীবরদীর ভায়াডাঙ্গা থেকে র‌্যাব ১টি আর্জেস গ্রেনেড পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ১১ অক্টোবর ঝিনাইগাতীর পানবর গ্রাম থেকে ১০টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে র্যাব।

Sherpur

২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর পুলিশ ওই বাকাকুড়া গ্রামের আছির উদ্দিনের বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ১৩ হাজার ৬৮০ রাউন্ড রাইফেলের তাজা গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর একই এলাকা থেকে বিজিবি পরিত্যক্ত অবস্থায় ৭ টি স্থলমাইন, ১ টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৯৭ রাউন্ড গুলি, ৩টি ওয়াকিটকি, ২টি এলএমজি লিংকেজ ব্যান্ড, ১৯টি বাংলাদেশি ও ভারতীয় মোবাইল সিম, বেশ কিছু সিডিসহ মোট ৩৮টি আইটেম এবং বিস্ফোরক তৈরির ফর্মূলাসহ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার প্রচুর সাংগঠনিক কাগজপত্র উদ্ধার করে।

২০১১ সালের ২৫ আগস্ট ঝিনাইগাতীর গজনী এলাকার একটি লোহার ব্রিজের মাটির নিচে প্লাস্টিকের বস্তাভর্তি পুঁতে রাখা অবস্থায় ডিবি পুলিশ ১ হাজার ২১৯ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি উদ্ধার করে। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর র্যাব-১২ গজনী অবকাশ কেন্দ্রের রাস্তার পশ্চিম পাশে বাঁকাকুড়া এলাকার জঙ্গল থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ট্যাংক বিধ্বংসী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেট লাঞ্চারের তিনটি তাজা গোলা উদ্ধার করে। এর আগে সেই বছরের ২৯ জুলাই কাংশার সীমান্তবর্তী একটি কালভার্টের নিচ থেকে বিজিবি জওয়ানারা চায়নিজ রাইফেলের ২৯০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। ৯ মে ভোরে বাঁকাকুড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৯৯৫ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের তাজা গুলি উদ্ধার করে। এর এক সপ্তাহ পর ঝিনাইগাতী থানা পুলিশ ১৭ মে গজনী এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্থানীয় একটি কালভার্টের নিচ থেকে প্লাস্টিকের দু’টি প্যাকেটে মোড়ানো পরিত্যক্ত অবস্থায় ৩৬৭ রাউন্ড একে-৪৭ ও চাইনিজ রাইফেলের তাজা গুলি উদ্ধার করে। ভারতঘেঁষা তাওয়াকুচা সীমান্তের গারো পাহাড়ের গহীন অরণ্যে ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট একটি গোপন সুরঙ্গের সন্ধান পায় পুলিশ। সেই সুরঙ্গটি খুঁড়ে ১৫১ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি উদ্ধার করা হয়।

এসব ঘটনা বিশ্লেষণে স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, এবার বুরুঙ্গা সীমান্তে র‌্যাবের উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ-অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের হতে পারে। তাছাড়া ২০১১ সালের জুনে র্যাবের হাতে ভৈরবে গ্রেনেডসহ গ্রেফতার হওয়া উলফা কমান্ডার রনজু চৌধুরীও পুলিশ-গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবদে বলেছেন, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে তারা আস্তানা করে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছিলেন।

নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের গারোপাড়া গ্রামের আদিবাসী নেত্রী বন্দনা চাম্বুগং বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতাকর্মীরা এ এলাকায় ঘোরাফেরা করতো। এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ তাদের হতে পারে। তিনি এ ঘটনায় সীমান্তের নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করার আহ্বান জানান।

পোড়াগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, এলাকাটি ভারতের মেঘালয় সীমান্ত সংলগ্ন। এই এলাকার কোনো লোকজন এ ধরনের অস্ত্র মজুদ করতে পারে সেটা মনে হয় না। তবে এক সময় এসব এলাকায় উলফারা বিচরণ করতো, অস্ত্রশস্ত্রগুলো তাদেরও হতে পারে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরাই এটা ভালো বলতে পারবেন।  

ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তী কাংশা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনারুল্লাহ বলেন, প্রায় এক দশক ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা ঝিনাইগাতী সীমান্তের গারো পাহাড়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়েছিল। উলফার লোকজন গারো পাহাড় এলাকায় আস্তানা তৈরি করলেও গত ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা এখানে টিকতে পারছিল না। বিভিন্ন সময় ঝিনাইগাতী সীমান্ত থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ উলফাদের হতে পারে। কারণ এসব গোলাবারুদের সঙ্গে আগে উলফাদের কাগজপত্র ও সামরিক পোশাকও পাওয়া গেছে।

এদিকে, বুরুঙ্গা সীমান্তে বনের ভেতর থেকে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের পর বন বিভাগের সমশ্চুড়া বিট কর্মকর্তা ইলিছুর রহমান বলেন, আমরা নিয়মিত এ এলাকা পরিদর্শন করি। চ্যাংবান্দা টিলায় এর আগে কখনো এমন গর্ত চোখে পড়েনি। অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত থাকতে পারে এমন কথা চিন্তায়ও আসেনি।

বারোমারী এলাকার স্থানীয় সাংবাদিক এম. সুরুজ্জামান বলেন, এক সময় উলফারা এখানে ছিল। এসব তাদেরই ফেলে যাওয়া হতে পারে। আর যারা ওদের সঙ্গে মেলামেশা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের মাধ্যমে এসব গোলাবারুদ উদ্ধারের চেষ্টা করছে।

সাধারণ মানুষ মনে করেন, এমন আরও অনেক অভিযানের মাধ্যমে এ রকম গোলাবারুদ উদ্ধার হবে।

জেলা প্রশাসক ডা. এ এম পারভেজ রহিম সাংবাদিকদের বলেন, একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ রেখেছিলো বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তদন্তে সব কিছু বেরিয়ে আসবে। তিনি সীমান্তের নিরীহ মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ দেন।                                                                   

এসএস/এমএস