ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের টাকায় পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ

প্রকাশিত: ১১:৩০ এএম, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের ভেতরে এ পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে জলাবায়ু ফান্ডের টাকা ব্যবহারের কথা থাকলেও তা দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

এছাড়া সংরক্ষিত বনের ভেতর পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণের কারণে বনটিও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে এ বনের জীববৈচিত্র্য। তার উপরে নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে অপরিকল্পিত এসব স্থাপনার স্থায়িত্ব নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা ও লালদিয়ার চরের এ বনাঞ্চলকে ঘিরে ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৫ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি নামে এ পর্যটন কেন্দ্রটি।

Barguna-Horinghata
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধিনে উপকূলীয় বন বিভাগ পটুয়াখালীর বন অধিদফতর এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, হরিণঘাটা বনবিভাগের প্রায় পরিত্যক্ত একটি একতলা টিনশেড ভবনের পাশ দিয়ে বনের ভেতরে যাওয়ার জন্য (পিলার টু পিলারে ঢালাই দিয়ে) প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পরিমাণ একটি সেতু তৈরি করা হয়েছে। এ সেতুর উপরে কোনোরূপ ছাউনি দেয়া হয়নি। এই সেতু থেকে নেমে অর্ধ কিলোমিটার পথ বনের ভেতর কাঁচামাটির আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে যেতে হয় রেইন্ট্রি তলা নামক একটি স্থানে। সেখানেই একটি ৫ তলা ওয়াচ টাওয়ার এবং গোলাকৃতির ছোট ছোট চারটি বিশ্রামঘর তৈরি করা হয়েছে। খানিক দূরেই খালপাড়ে বানানো হয়েছে একটি ঘাট।

জেলা শহর বরগুনা থেকে আসা দর্শনার্থী রিয়াজ আহম্মেদ (২৭) জানান, হরিণঘাটার ইকো ট্যুরিজম পার্কে এসে তিনি হতাশ হয়েছেন। এখানে দেখার মতো কিছুই নেই। একটি মাত্র ওয়াচ টাওয়ারে উঠে শুধু বন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তিনি আরও বলেন, আশে পাশের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো হোটেল ও রেস্টুরেন্ট।

Barguna-Horinghata

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেইন্ট্রি তলার খালপাড়ে যে ঘাটটি তৈরি করা হয়েছে মাটির নীচে তার কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়াও তৈরির মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঘাটের বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল ধরেছে বলেও জানান স্থানীয়রা। ওইসব ফাটল যেন চোখে না পড়ে সেজন্য সম্প্রতি সেসব ফাটলে পুনরায় সিমেন্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়া হয়েছে। ফাটল ঢাকতে একই রকম প্রলেপ দেয়া হয়েছে পাঁচতলা টাওয়ারেও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালদিয়ার চরসহ হরিণঘাটা বনকেন্দ্রের অধিনে রয়েছে প্রায় ১২শ একর বনভূমি। সুদীর্ঘ বছর ধরে গড়ে ওঠা এ বনভূমিতে গরাণ, গেওয়া, ছেলা এবং কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। সুন্দরবনের পরে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ম্যানগ্রোভ বনভূমি এটি। একসময় এখানে হরিণের প্রাচুর্য্য থাকলেও ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে এ বনে হরিণের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। তাছাড়া নদীমাতৃক অঞ্চল হওয়ায় হরিণঘাটার এ বনভূমিতে জালের মতো ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট অসংখ্য নদী ও খাল। এসব খালে প্রতিদিন চলে জোয়ার ভাটার খেলা। তাই চাইলেই এ বনের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না।

Barguna-Horinghata
এ ৬ প্রকল্পের সমস্যা সম্ভাবনা ও নিন্মমানের কাজ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, এ প্রকল্পের বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। এসব বিষয়ে তার সঙ্গে কেউ কোনো প্রকার যোগাযোগ করেননি। তার কোনো মতামতও নেয়া হয়নি। ওয়াচ টাওয়ার, ঘাট, সেতুসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে অতি নিন্মমানের কাজের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা পারভিন জানান, তিনি সরেজমিন এ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেছেন। এ প্রকল্পের অধিনে নিন্মমানের কাজ দেখে তিনি চরমভাবে হতাশ হয়েছেন।  

তিনি বলেন, সংরক্ষিত এ বনের ভেতরে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করায় বনটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। পর্যটন কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে এ বনে স্থানীয় হরিণ শিকারি চক্রের দৌড়াত্ম্য বেড়েছে। এর ফলে বনে হরিণের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

তিনি জানান, সারাদিন হেঁটেও এ বনের কোথাও একটি হরিণের দেখা মেলা ভার। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, ওয়াচ টাওয়ার এবং খালপাড়ের ঘাট নিয়ে তিনি ভিষনভাবে শঙ্কিত। বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় এবং তার সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হলে এসব স্থাপনা বিধ্বস্ত হতে পারে। এছাড়াও এ প্রকল্প এলাকার আশে পাশে কোনো হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বনের মধ্যে তেমন কিছু দেখার না থাকায় দর্শনার্থীরা এখানে এসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলেও তিনি জানান।

এ বিষয়ে পরিবেশ কর্মী ও স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানির প্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন ফসলি হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও কম বৃষ্টিপাতের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এজন্য বরগুনায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

বরগুনার সিংহভাগ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার জানিয়ে হোসনেয়ারা হাসি বলেন, নদী ভাঙনের ফলে এখানের কৃষকরা তাদের চাষের জমি হারাচ্ছে। হারাচ্ছে তাদের বসতভিটাও। কাজ নেই, মাথা গুঁজার ঠাঁইও নেই, নেই খাদ্য কেনার পয়সাও। এখানকার মৎস্যজীবীরা তাদের পূর্ব পেশা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখানের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ উদ্বাস্ত হয়ে গ্রামের সুশীতল ছায়া ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ইট-পাথরের শহরে।

Barguna-Horinghata
এ বিষয়ে স্থানীয় পরিবেশ কর্মী ও সাংবাদিক সোহেল হাফিজ বলেন, কোনোরূপ যাচাই বাছাই না করেই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে এসব কাজ করা হয়েছে। কাজের মান অত্যন্ত নিন্মমানের। জোয়ার-ভাটার এ নিন্মভূমিতে এসব নিন্মমানের স্থাপনা ক’দিন টিকে থাকবে এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে শংকা রয়েছে।

বন বিভাগ পাথরঘাটা রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. সোলায়মান হাওলাদার জানান, হরিণঘাটা বনাঞ্চলকে ইকো ট্যুরিজম হিসেবে গড়ে তুলতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জলবায়ু ট্রাস্টের তহবিলের আওতায় বনের ভেতর একটি ঝুলন্ত সেতুসহ ৯৫০ মিটার পায়ে চলা পথ (ফুট ট্রেইল) নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও বনের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ ফুট উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার, টারটি গোলঘর, ১০টি বেঞ্চ এবং একটি ঘাট।

এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অজিত রুদ্র জানান, বন এবং বন্যপ্রাণির প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং মমত্ববোধ সৃষ্টির জন্য বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের ভেতরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ পর্যটন কেন্দ্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের বন বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ বনে পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণ করায় স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটন কেন্দ্রের জন্য এ বন এবং বনের প্রাণিদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা জন্মাবে। এর ফলে বন উজার এবং বন্যপ্রাণি শিকার হ্রাস পাবে বলেও জানান তিনি।
 
এমএএস