ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে সাইকেল কন্যারা

প্রকাশিত: ০৪:৫৯ এএম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

এক দল তরুণী। বেলের টুং-টাং শব্দ। উদ্যম হাসি ঝড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। তারা স্কুলে যাচ্ছে। তারা পড়বে। বড় হবে। স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্নে বিভোর। সূর্যাস্তের সময় নীড়ে ফেরা পাখির কলকাকলির মতো তারা যখন রাস্তা মুখরিত করে দল বেধে সাইকেলে চেপে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে তখন কর্মব্যস্ত মানুষও তাদের দিকে অপার আনন্দে তাকিয়ে থাকে। বলছিলাম কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ার বিলুপ্ত ছিটমহলের তরুণীদের কথা।

যেখানে কদিন আগেও ছিল না স্কুলের কোনো বালাই। দশ পেরুলেই বিয়ের পীড়িতে বসতে হতো। মাতাল আর অসভ্য লোকদের অত্যাচারে মেয়ে শিশুদের রাখা হত পর্দার অন্তরালে। আজ তারা বেড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। সামাজিক সকল প্রতিকূলতা ভেঙে শিক্ষার আলো আহরণ করতে ছুটে চলেছে শিক্ষালয়ে। এখন আর বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। তাদের দাবিয়ে রাখার কেউ নেই। সরকারের সকল বিভাগসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষ তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সকলে সহমর্মিতা জানাচ্ছেন। পুরুষরা এই সফলতার ভাগি হলেও পিছিয়ে নেই নারীরাও। তারা নিজেদের জীবনে যে সুযোগ পায়নি সেই সুযোগ করে দিচ্ছে সন্তানদের। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরকও তারা স্কুলে পাঠাচ্ছেন। আর এই গ্রামের সকল কিশোরীরা দল বেঁধে সাইকেলে চেপে স্কুলে যায়।

দাশিয়ারছড়া নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৭৫ ছাত্রী চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে। সরকারিভাবে বই সরবরাহ করা হয়েছে। এখানকার নুরজাহান (৭ম শ্রেণি), লিমা খাতুন (৬ষ্ঠ শ্রেণি), জেসমিন আক্তার (৭ম শ্রেণি), জান্নাতি বেগম (৭ম শ্রেণি), নাসিমা খাতুন ( ৭ম শ্রেণি), মুলকি আক্তার মুন্নি (৭ম শ্রেণি), বিপ্লবী রায় (৮ম শ্রেণি), জাহিদা খাতুনসহ (৮ম শ্রেণি) বেশ কয়েকজন প্রতিদিন ২/৩ কি. মি. দূর থেকে বাইসাইকেলে করে স্কুলে আসে প্রাইভেটে যায় এমনকি বেড়াতেও। দাশিয়ারছড়ার অধিকাংশ মেয়ে বাইসাইকেল চালাতে পারে। কিন্তু সবার নিজের সাইকেল না থাকায় তারা কষ্টে পড়েছে। রিকশা কিংবা ভ্যান নেই। তাই হেঁটে হেঁটে যেতে হয় স্কুলে।

৬ষ্ঠ শ্রেণির সাবনাজ খাতুন, ৭ম শ্রেির আলপনা খাতুন বলেন, তাদের ৩ থেকে সাড়ে ৩ কি. মি. রাস্তা হেঁটে যেতে হয় স্কুলে। পরিবারে সামর্থ্য নেই সাইকেল কেনার। অথচ একটা সাইকেল হলে কষ্ট করতে হতো না।

konna

নাসিমা খাতুনের বাড়ি আটিয়াবাড়ী গ্রামে। আড়াই কি. মি. গ্রামীণ রাস্তা পেরিয়ে সাইকেলে আসে দাশিয়ারছড়া নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। কৃষিজীবী বাবা নুর মোহাম্মদের সাইকেল নিয়ে সে আসে। সঙ্গে আনে একই পাড়ার ৫ম শ্রেণির ছাত্রী রিনা খাতুনকে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। বড় দু ভাইয়ের পড়ালেখা হয়নি। নাসিমার স্বপ্ন পড়ালেখা শেষ করে স্বাবলম্বী হবে।

বাবা নুর মোহাম্মদ বলেন, স্বাধীন দেশে বাড়ির পাশে মেয়েকে পড়াতে পেরে খুব খুশি লাগছে। সাইকেল চালিয়ে যাওয়ায় ব্যয় কমেছে। দ্রুত স্কুলে যেতে আসতে পারছে। আমার ইচ্ছা মেয়ে পড়াশুনা করে চাকরি করবে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই উৎসাহ দেয়। ভাল কথা বলে।

নুরজাহান, লিমা খাতুন, জেসমিন আক্তার, জান্নাতি বেগম, মুলকি আক্তার মুন্নি, বিপ্লবি রায় অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমরা সবাই নিরাপদ মনে করি সাইকেলে আসতে। স্বাধীনভাবে আনন্দের সঙ্গে হেসেখেলে চলাফেরা করতে পারছি। এভাবে স্কুলে যেতে খুব ভাল লাগছে। বাড়ি থেকেও কোন বাধা নেই। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও এখন আর নেই। যাদের সাইকেল নেই তারা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে। তবে অন্য সবার সাইকেল থাকলে চলাচল পরিবেশ আরো ভাল হতো।

মুলকি আক্তার মুন্নির মা জোবেদা বেগম (৫৬) বলেন, তিন ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে মুন্নি সবার ছোট। আমরা ছোট গৃহস্থ মানুষ। খাঁচার বন্দি জীবনের কারণে বড় ২ ছেলের পড়ালেখা হয়নি। একজন দিল্লীতে ভাটায় কাজ করে। আর এক ছেলে ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। ছোট ছেলে জাকির মিথ্যা পরিচয়ে আগে থেকে বাংলাদেশে পড়ছে। নিজে লেখাপড়ার সুযোগ না হওয়ায় মনে অনেক কষ্ট-দুঃখ। পরিবারে অশান্তি, অভাব। এ উপলব্ধি থেকে মেয়েকে পড়াতে চায় যেন মানুষ হতে পারে। মেয়েকে বাইসাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে দেখে নিজেরই ভাল লাগে। মনে হয় আমার ছেলেবেলা যদি এমন হতো। এরই নাম হয়তো স্বাধীনতা। তা আগে বুঝতে পারিনি।

বিপ্লবির মা সুনতি রানী বলেন, মেয়ে আমার সাইকেলে স্কুলে যায় কারণ রিকশা ভ্যান নাই। হেঁটে যেতে হয় ৩ কি. মি. পথ। সাইকেলে অনেক নিরাপদ মনে হয় আমাদের। স্কুল ছুটির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরে। প্রয়োজনে বাজারও করে আনতে পারে। মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বিপ্লবি সবার বড়। সাইকেল চালাতে পাড়ায় ওই আমার ছেলে ওই আমার মেয়ে।

সাবনাজের বাবা শাহালম খন্দকার কৃষিজীবী। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে দুই মেয়ের কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। তাই ছোট মেয়ে সাবনাজকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াতে চান। সাবনাজ ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়লেও এখন থেকে আমার সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে। তাই যাতায়াতের ব্যয় নেই। স্কুলের শিক্ষকরাও নজরে রাখে। পাড়া প্রতিবেশীরা সহযোগিতা করে।

দাশিয়ারছড়া সাবেক গ্রাম পঞ্চায়েত ৮৫ বছরের বৃদ্ধ শাহের আলী মেম্বার জানান, `শেখ মুজিব যেমন দয়ালু ছিল তার বেটি তেমন দয়ালু। ভাইপবার পাংনা  ব্যাহে, কোন বুদ্ধি দিয়া হামার ছিটটা বাংলাদেশ করি ফেলাইল। কোন দিনও হামার এ্যাটে আইন টাইন ছিল না। ওমরা আইন করিয়া হামার নিরাপত্তা করি দিল। এ্যাটাকি ভুলবার মতন। এ্যালা হামার বেটিরা (মেয়ে) সাইকলত চড়ি স্কুল যায়।`
 
ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা বলেন, বন্দি থেকে মুক্ত হলাম আমরা। এ আনন্দে ছিটমহলবাসীরা আজ আনন্দে আত্মহারা। তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়সহ ৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি কলেজিয়েট স্কুল এবং একটি দাখিল মাদরাসা চালু হয়েছে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় আড়াইশ মেয়ে পড়ালেখা করছে। তাদের অনেকে বাইসাইকেলে আসে। আগে তা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার।  

প্রধানমন্ত্রীর দাশিয়ারছড়া পরিদর্শন :

নতুন প্রস্ফুটিত ফুলের গোছা পেয়েছি ছিটবাসীদের কাছ থেকে। আপনাদের আর বঞ্চনা থাকবে না। ছিটমহলবাসীরা আর ছিট হিসেবে চিহ্নিত হবে না। তারা এখন জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হবে। এতদিন ছিল বঞ্চনার ইতিহাস। এখন আর বঞ্চনা থাকবে না। জাতির পিতা বেঁচে থাকলে আপনাদের এই বঞ্চনা এতদিন থাকত না। আপনারা রাষ্ট্র পেতেন অনেক আগেই। সফলতা পেতেন। পেতেন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করেছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভের পর মুজিব-ইন্দিরা স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের কুটনৈতিক বিজয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ছিটমহলের স্বাধীনতা। ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দাশিয়ারছড়া সফর এসে এসব কথা বলেন।   

konna

সাবেক ছিটমহলবাসীদের আপন করে নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছিটমহলবাসীদের তিনি বলেছেন, কেউ যেন আর নিজেকে ছিটবাসী মনে না করেন, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের অংশ এবং অধিবাসীরা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার একগুচ্ছ প্রস্ফুটিত ফুল, তাদের সব বঞ্চনার অবসান হবে। আপনারা বাংলাদেশের সন্তান, নাগরিক। আপনাদের দুঃখের রজনী শেষ হয়েছে। নতুন আলোকিত জীবনে প্রবেশের সময় এসেছে।

ছিটমহল উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ :

গত বছর সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলে ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৭ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। চলতি বছর একনেকে পাশ করা হয় ১৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে একটি অত্যাধুনিক ইউনিয়ন কমপ্লেক্স। ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি মাধ্যমিক, ১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১টি মাদরাসা স্থাপন করা হবে। এলজিইডির বিশেষ বরাদ্দে নির্মাণ করা হবে ১টি পাবলিক লাইব্রেরি কাম কমিউনিটি সেন্টার। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও ১টি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র স্থাপনসহ কৃষি খাতে ৭টি, বিআরডিবির ৭টি, সমবায় অধিদফতরের ৬টি এবং নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে সদ্য বিলুপ্ত দাশিয়ারছড়ার সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি।

ছিটমহলের সৃষ্টি ও মুক্তি :

উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতের স্থল সীমান্ত নিয়ে এই সমস্যাটি পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৬২ছিটমহলের উৎস ও অবস্থান ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তের সময় মানচিত্র বিভাজনের সময় ছিটমহলের উদ্ভব ঘটায়। এক দেশের ভূখণ্ড থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। কোচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন উপজেলা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ,পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট ও ফুলবাড়ীতে অবস্থিত ছিল। পাক-ভারত বিভক্তির সময় ওই ৮ উপজেলা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পড়ে যায়। আর কোচবিহার একীভূত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের ভিতরে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতের অভ্যন্তরে।

এই ভূমিগুলোই হলো দীর্ঘ ৬৮ বছরের আলোচিত ছিটমহল। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ২টি ছিটমহলের ভূখণ্ডের ভেতরে ১৫০নং ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার আয়তন ১ হাজার ৯৪৩ একর। ছিটমহলটিতে ৭ হাজার ১৫৮ জন মানুষের বাস। আর ভুরুঙ্গামারীতে রয়েছে ১০টি ছিটমহলের আয়তন ৩শ একর জমিতে ১ হাজার ৪৩০ জন মানুষের বসবাস। এসব ছিটমহলে বর্তমান বসবাস করছে প্রায় ৫১ হাজার মানুষ। ২৪ হাজার ২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দু’দেশের ছিটমহল। এর মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৫ একর এবং বাংলাদেশের ৭ হাজার ১১০ দশমিক ৩ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে।

এর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় ৪টি ভারতীয় ছিটমহল ছিল। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে কোচবিহার রাজ্যে ৪৭টি এবং জলপাইগুড়ি জেলায় ৪টি ছিটমহল রয়েছে।

এসএস/এমএস