‘রাষ্ট্রের পাশাপাশি কৃচ্ছ্রসাধন করা ব্যক্তিরও নৈতিক দায়িত্ব’
অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বিশ্ববাজারে খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষকে ‘কৃচ্ছ্রসাধন ও সাশ্রয়ী’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদেশ সফর বন্ধ ব্যাংক কর্মকর্তাদের। কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলা হয়েছে বেসরকারি পর্যায়েও।
সমসাময়িক এসব প্রসঙ্গে লেখক, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর এমন পরামর্শকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কৃচ্ছ্রসাধন আসলে চর্চার বিষয়। সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবশ্যই সাধুবাদ জানানো যায়। কিন্তু কৃচ্ছ্রসাধনের আরও অনেক জায়গা রয়েছে। যেমন- আমাদের পাড়ার দোকানগুলোতেও বিদেশি বিস্কুট পাওয়া যায়। অথচ আমাদের দেশেই ভালো ভালো বিস্কুট উৎপাদন হচ্ছে।’
‘আমি মনে করি, যেসব পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদন হয়, সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে বহু টাকা বিদেশে চলে যায়। আবার সিগারেটের মতো পণ্যে উচ্চ শুল্ক দিতে পারেন। কারণ সিগারেট জনগণের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য যা প্রয়োজনীয় তার শুল্ক কমানো দরকার। যেমন- প্রয়োজনীয় ওষুধের ওপর শুল্ক কমানো সময়ের দাবি। আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য রক্ষা করা ক্রমাগত একটি প্রক্রিয়া। একটি সময় ধরে করলে হবে না।’
বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘সব বিশ্ব এক ধরনের সংকটের মধ্যে আছে। এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। যুদ্ধ যে কোনো দিন শেষ হয়ে যেতে পারে। তখন এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের ভারসাম্য নীতি অবলম্বন করা জরুরি। এ কারণে আমি মনে করি, জাতীয় পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা দরকার। সেখানে অর্থনীতিবিদ থাকবেন। সরকারের একজন প্রতিনিধি সাচিবিক দায়িত্বে থাকতে পারেন। বাজার বিশেষজ্ঞ থাকবেন এই কমিটিতে। তারা দেখবেন কোন বিষয়গুলো আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন- কৃষির জন্য মেশিনারি, সার আমাদের অধিক পরিমাণে দরকার। এগুলোর ওপর জোর দেওয়া সময়ের দাবি।’
‘সরকার বিদেশ সফর বা ট্যুরিজম প্যাকেজের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করছে সেটাও সময়ের দাবি। জনগণেরও উচিত হবে এই মুহূর্তে ট্যুরিজম প্যাকেজগুলো থেকে দূরে থাকা। কারণ জাতির সংকট চলছে। এ কারণে ব্যক্তির জায়গা থেকেই কৃচ্ছ্রসাধন করা দরকার। এটি সরকার আরোপিত বিষয় বলে মনে করি না। ব্যক্তিরও দায়ের ব্যাপার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি কৃচ্ছ্রসাধন করা ব্যক্তিরও নৈতিক দায়িত্ব। ভ্রমণ বাবদে যে পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা আটকানো গেলে সরকার জ্বালানি, সারের মতো পণ্য কিনতে পারবে। কৃষকের এখন এগুলো কম দামে কেনা জরুরি। কৃচ্ছ্রসাধন নিয়ে আমাদের এখন অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।’
এই শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক বলেন, ‘আবার অবাঞ্ছিত ব্যয়ের জন্য সরকারও দায়ী বলে মনে করি। সরকার নিজেও স্বীকার করছে কিছু প্রকল্প আরও পরে করলে ক্ষতি হবে না। নানাভাবেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। সময় বাড়ানো হচ্ছে। এজন্যই একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি থাকা দরকার যেখানে সরকারও প্রতিনিধি থাকবে। কমিটি প্রতি মাসেই বৈঠকে বসে তাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত জানাবে।’
রপ্তানির ওপর জোর দিয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘রপ্তানি বাড়াতে আরও উৎসাহিত করতে হবে। আমরা তো গার্মেন্টশিল্পসহ মাত্র কয়েকটি পণ্য রপ্তানিতে অভ্যস্ত। অথচ পাটের ওপর জোর দিচ্ছি না। পৃথিবীব্যাপী প্লাস্টিকের বিরোধিতা হচ্ছে। পাট থেকে প্লাস্টিক হচ্ছে। এটি বাজারজাত করতে পারলে বিশ্বে চাহিদা বাড়বে। রপ্তানিতে প্রচুর আয় হবে। আউটসোর্সিংয়ে আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। তরুণদের যুক্ত করতে পারলে বেকারত্ব কমবে। গ্রাফিক্সের কাজের জন্য প্রশিক্ষণ বাড়ানো দরকার। নার্সিং সেবায় বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে। আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারি। এ খাতগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। রপ্তানি আয় কীভাবে বাড়ানো যায় বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করবেন।’
টেকসই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘স্থায়ী সমাধানে আসতে হবে। সংকট দেখা দিয়েছে বলে হাঁটু ঝাঁকিয়ে কাজে নেমে গেলাম, এটি করলে হবে না। সংকট থাকুক বা না থাকুক অতিরিক্ত খরচ, লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। প্রতি বছর সাত বিলিয়ন ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে। এই অর্থ ঠেকাতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরে বিদেশিরা এসে কাজ করছে। তারা উচ্চ মাইনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিকল্প, সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।’
‘আমাদের সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিশ্বে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী সংঘাত চলছে। আমরা নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছি। শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হবে। ইউএন চার্টারের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তি রয়েছে। এই মিশনে আমাদের আরও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে আয় বাড়বে, সুনামও বাড়েবে।’
তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স নিয়ে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। ভালো উদ্যোগ। হুন্ডির মাধ্যমে টাকার বৈধ হিসাব করা যায় না। সরকার ঠকছিল। আমি মনে করি, রেমিট্যান্সের জন্য প্রণোদনা আরও বাড়ানো হোক। এক মিলিয়ন প্রণোদনা দিয়ে যদি এক বিলিয়ন রেমিট্যান্স বাড়ানো যায়, তাতে দেশেরই লাভ। আমি অর্থনীতিবিদ নই, কিন্তু এই বিকল্পগুলো নিয়ে যে কেউ-ই ভাবতে পারেন এবং ভাবনার সময় এসেছে বটে।’
‘আমার অনেক ছাত্রই বিভিন্ন সেক্টরে আছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের কাছ থেকেও শিখছি, জানছি। মিডিয়া থেকেও এখন সহজেই সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে জানা যায়। জানাটা এবং ভাবনার প্রয়োগ কিন্তু প্রত্যেক মানুষের জন্য নৈতিক দায়।’
‘বিদ্যুতের সংকট চলছে। এই মুহূর্তে যদি সব সময় এসি চালাই, তাহলে আমি দায়িত্ববান মানুষ হতে পারলাম না। একজন শিক্ষার্থীর সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্নের জন্য তিনদিন আমি বিদ্যুৎহীন থাকতেও রাজি আছি। সহানুভূতি সমাজ থেকে চলে গেলে নৈতিকতার অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।’
সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। কিন্তু সবকিছুই কেন প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে! অপচয় আমরা কেন করবো। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সামনে আসার কারণেই হয়তো আমাদের এভাবে ভাবতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে দুই ধরনের ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করছে যে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার পথে। আমি নিজে মনে করি, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে না বা না হোক। কিন্তু হতেও পারে। হয়ে গেলে তখন আমাদের অবস্থা কী হবে! কেউ কী ভালো থাকবো? এ কারণে সে পরিস্থিতি হওয়ার আগেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
দোকানে গিয়ে দেখলাম, একটি বিদেশি টুথপেস্টের দাম সাতশ টাকা। অবাক হলাম। আমি বললাম, এত টাকা খরচ করে দাঁত পরিষ্কারের প্রয়োজন নেই। দেশে উৎপাদন হয় যেটা, তাই দাও। আমি ইন্ডিয়ার শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশের কেয়া সাবানের জন্য মানুষ পাগল। সে দেশে প্রাণের জুস দেদারসে চলছে। আমরা কেন পাকিস্তানের জুসের জন্য তাকিয়ে থাকবো। রুহ আফজায় কী এমন আছে যে পাকিস্তান থেকে আনতে হবে। এই প্রশ্নগুলো এখন তুলতে হবে। কিন্তু কে তুলবে এমন প্রশ্ন? এ কারণেই বলছি, শক্তিশালী একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা দরকার, যারা প্রশ্ন তুলে সমাধানও করতে পারবেন। ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা, জরিমানা করার ক্ষমতা দিতে হবে এই কমিটিকে– যোগ করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
এএসএস/এএসএ/এএসএম