আরও সময় চান ট্যানারি মালিকরা
হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরে সরকারের দেয়া উকিল নোটিশের সময় আজ (সোমবার) শেষ হচ্ছে। রোববার বিকেল পর্যন্ত ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান উকিল নোটিশের জবাব দিয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নোটিশের জবাব দিলেও ট্যানারি স্থানান্তরে আরও সময় চান মালিকরা। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আল্টিমেটাম দিলেও হাজারীবাগেই ঘুরছে ট্যানারির চাকা।
রোববার রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার বিভিন্ন ট্যানারি ঘুরে দেখা যায়, সরকারের উকিল নোটিশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোদমে কাজ চলছে। নোটিশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার ট্যানারি। এই ট্যানারিতে চামড়া ডায়িং, ফিনিশিংয়ের কাজ করছে শ্রমিকরা।
কারখানায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, আসলে আমাদের মালিকের তিনটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো- বে ট্যানারি, আজিজ ট্যানারি ও পাইওনিয়ার ট্যানারি। হেড অফিস টিসিবি ভবনে। আমাদের মালিকের খুব কাছের আত্মীয় হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা। তিনি সাভার শিল্প নগরীতে তিনটি প্লট পেয়েছেন। এর মধ্যে বে ট্যানারির কাজ পুরোদমে চললেও অন্য দুটির কাজ চলছে ধীর গতিতে। আর এ কারণে সরকার উকিল নোটিশ দিয়েছে। বে ট্যানারিতে গিয়ে মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।
মিজান নামের একজন বলেন, আমি এখানে কর্মরত। স্যারেরা সবাই হেড অফিসে বসেন।
এদিকে ইউসূফ ট্যানারির মালিক বলেন, আমরা সরকারের উকিল নোটিশের জবাব দিয়েছি। আমরা কাজ শুরু করেছি। কিন্তু যেদিন রিপোর্ট নেয়া হয়েছে সেদিন আমাদের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। উকিল নোটিশের জবাবে সরকারকে জানিয়েছি আমরা কাজ করছি। কতটুকু কাজ হয়েছে এ পর্যন্ত তাও উকিল নোটিশের জবাবে উল্লেখ করেছি।
তিনি বলেন, আসলে আমরাও সাভার যেতে চাই। কিন্তু সাভারে এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সেন্ট্রাল ইটিপির কাজ চলছে। কিন্তু সরকারের কাজ যদি পুরোপুরি শেষ না হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সেখানে গিয়ে বসে থাকতে হবে। তাই সাভারে কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তো আর বসে থাকা যাবে না। হাজারীবাগে কাজ চলবে নয় তো বন্ধ করে বসে থাকতে হবে।
ওই মালিক আরো বলেন, সরকার ইচ্ছে করলে হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দিতে পারবেন। কিন্তু তার আগে তো সাভার শিল্পনগরী প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।
এদিকে, ইব্রাহিম ট্যানারির কর্তৃপক্ষ বলেন, আমাদের কারখানা সাভারে স্থানান্তর করবো। কিন্তু সময় লাগবে। সাভারে যে প্লট আমরা পেয়েছি সেখানে কাজ চলছে। তারপরও আমাদের নামে নোটিশ দিয়েছে সরকার। তার জবাব দিয়েছি আমরা। তবে এ নোটিশের কারণে ব্যবসায়িক ভিত্তি নষ্ট হয়েছে।
তিনি বলেন, সাভারে একটি কারখানার ভিত্তি স্থাপন করতে ৮০ থেকে ৯০ ফিট পাইলিং করতে হয়। যেখানে অনেক টাকার প্রয়োজন। সরকার যে অর্থ দিচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাংক ঋণের সহায়তা করেছে সরকার। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাংক ঋণের সহায়তা পাচ্ছি না। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের ব্যাংক ঋণের সুবিধা দিলে আমরা অতি দ্রুত কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারবো।
এর আগে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে প্লট বরাদ্দ ও সরকারি অর্থ সহায়তা নেয়ার পরও যে সব প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ শুরু করেনি তাদের উকিল নোটিশ দেয় সরকার। গত বুধবার বেলা ১২টায় দেয়া নোটিশ প্রাপ্তির তিন কার্যদিবসের (৭২ ঘণ্টা) মধ্যে জবাব দেয়ার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব দিতে ব্যর্থ হলে বা সাভারে ট্যানারির কাজ শুরু না করলে তাদের গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হবে বলে নোটিশে জানানো হয়। উকিল নোটিশটি পাঠিয়েছে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুল ইসলাম।
নোটিশ পাঠানোর আগে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। সেই আলটিমেটামের সময় পার হওয়ার পর আরও ৭২ ঘণ্টা সময় বেধে দিয়ে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে সেগুলো হলো- মেসার্স কাদের লেদার কমপ্লেক্স, ঢাকা ট্যানারি, ইউসূফ লেদার কর্পোরেশন, ইব্রাহিম লেদার, চাঁদপুর ট্যানারি, সিটি লেদার ট্যানারি, ক্যাপিটাল ট্যানারি, ইন্টান্যাশনাল ট্যানারি, ভূঁইয়া ট্যানারি, রুবি লেদার কমপ্লেক্স, হোসেন ব্রাদার্স ট্যানারি, ইউসূফ ট্যানারি, চৌধুরী লেদার অ্যান্ড কোং, হেলেনা এন্টারপ্রাইজ, আলেয়া ট্যানারি, শাহী ট্যানারি, নজরুল ট্যানারি, রোশনী কমপ্লেক্স, কমলা ট্যানারি, জিন্দাবাদ ট্যানারি, পাইওনিয়র ট্যানারি, আজিজ ট্যানারি, মুক্তি ট্যানারি, লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ, ডেল্ট্রা লেদার কমপ্লেক্স,গোন্ডেন লেদার এবং এইচ এস ট্যানারি।
চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল কাইউম বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ২৭ বার তাগিদ দিয়েছি হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি কারখানা স্থাপন কাজ তরান্বিত করতে। এরপরও অনেকে কাজ শুরু করেননি।
তিনি বলেন, ২৮ ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের ২০ শতাংশ অর্থ নিয়েও সাভারের শিল্প নগরে দৃশ্যমান কোনো কাজ করেনি। তাই তাদেরকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। এরপরও যারা কাজ করেননি তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আমরা চাই তারা কাজ শেষ করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করুক।
উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে হাজারীবাগের চামড়া শিল্প স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারে চামড়া শিল্প নগরী স্থাপন করেছে সরকার। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা অর্থিক সহযোগিতাও সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
এদিকে চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে প্রয়োজনীয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে ইউরোপীয় ক্রেতাদের দিক থেকেও ওই এলাকায় ট্যানারি কারখানাগুলো স্থানান্তরের চাপ রয়েছে। এমনকি পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত শিল্পের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে রফতানি নিষেধাজ্ঞারও আশঙ্কা রয়েছে। তাই ট্যানারি স্থানান্তর জরুরি বলে মনে করছে সরকার।
এসআই/একে/এআরএস/এমএস