ভাসমান শিশুদের স্বপ্নের পাঠশালা
রাজধানীর ভাসমান শিশুদের বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্নের পাঠশালা’। স্বল্পসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ভাসমান শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দান করছেন। তাদের স্বপ্ন হতদরিদ্র শিশুদের পড়াশুনা করিয়ে ভবিষ্যতে তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আর তাই নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘বৃক্ষমায়া’ নামক সংগঠনের টিন শিডের নীচে সপ্তাহে তিনদিন স্বপ্নের পাঠশালা স্কুলের ক্লাস চলছে। শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার দুই ঘণ্টা করে চলছে স্বপ্নের পাঠশালা স্কুলটির ক্লাস।
আজ মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে চার থেকে আট নয় বছর বয়সী ১২-১৪ জন শিক্ষার্থীকে বর্ণমালা শিখাচ্ছিলেন জুই, মোস্তারিন ও রাখি নামের তিনজন শিক্ষিকা। এদেও কেউ গাহস্থ্য অর্থনীতি আবার কেউ বদরুনেসা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াশুনা করছেন।
বয়সে অনেক বড় হলেও তারা ছোট শিশুদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করছিলেন। মাঝে মাঝে পড়া বন্ধ রেখে ছড়া, কবিতা ও গাণ গাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। আর তাই শিশুরা খুব আনন্দের সাথে ক্লাস করছিল।
এক পর্যায়ে তিন শিক্ষিকা চোখে ওড়না বেঁধে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ ছড়া কেটে চোর পুলিশ খেলা খেলছিল। খেলাধুলা শেষে শিশুদের টিফিন হিসেবে পরোটা ভাজি দিলে শিশুদের চোখে মুখে আনন্দ লক্ষ্য করা যায়।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষিকারা জানান, সমাজে এদের মতো অনেক ভাসমান ও অনাথ শিশুরা নিরক্ষর রয়েছে। এদের কারও বাবা নেই, মা নেই, কারও বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, কারও মা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করছে, বাবা রিকশাচালক কিংবা বেঁচে নেই। অভিভাবকরা তাদের স্কুলে ভর্তি করতে ইচ্ছুক নয় কিংবা অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয় না।
প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষাীর্থ আহসান আহমেদ শুভ জানান, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত এ সব শিশুদের ন্যুনতম পড়াশুনার সুযোগ করে দিতে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি উদ্যোগী হয়ে একটি গ্রুপ খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ ধরনের একটি মহৎ কাজের প্রস্তাব দিলে একে একে বেশ কিছুসংখ্যক তরুন তরুনী গ্রুপে যুক্ত হয়ে এর সাথে জড়িত থেকে কাজ করতে আগ্রহী হয়। বর্তমানে তাদের ওই গ্রুপে সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০জন।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েকজন তরুণ তরুণী একসঙ্গে স্বপ্নের পাঠশালা শুরু করতে সম্মত হন। সেখানেই স্কুলটি চালু করার কথা থাকলেও পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় তারা স্কুলের কার্যক্রম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চালুর চিন্তা ভাবনা করেন। ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়।
জুঁই নামের একজন শিক্ষিকা জানান, তারা শুধুমাত্র অক্ষরদানই করেন না, শিশুদের অসুস্থতায় ডাক্তার দেখানোসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন।
স্কুল পরিচালনায় অর্থের উৎস কী জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের সদস্যরা প্রতিমাসে কমপক্ষে একশ টাকা করে চাঁদা দেন। ফেসবুকে তাদের কার্যক্রম দেখে একজন দানশীল ব্যক্তি গত তিনমাস যাবত প্রতিমাসে পাঁচহাজার টাকা করে অনুদান দিচ্ছেন।
বৃষ্টি, ভাবনা, মিনা নামের তিন শিশুর কাছে এ প্রতিবেদক আপারা কি শিখাচ্ছেন জানতে চাইলে শিশুরা সমস্বরে বলে ওঠে অনেক কিছু শিখায়। অ আ ক খ, গ ও ঘ আরও কত কি। তোমরা ছড়া শিখেছো বলতেই একজন আতা গাছে তোতা পাখি, আরেকজন বাক বাকুম পায়রা ছড়া গাইতে লাগলো।
ওই তিন শিশুর চেয়ে সামান্য একটু বড় একটি ছেলেকে কি শিখছো বলতেই রাখি নামের শিক্ষিকা বলেন, শিশুটি বোবা তবে ওদের চেয়ে অনেক ভাল লিখতে পারে। এভাবেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা একদিন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই তাদের সকলের প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন।
এমইউ/এআরএস/পিআর