ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

‘স্কুল চালাতে আবার অনুমোদন কীসের?’

মুরাদ হুসাইন | প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

** চটকদার বিজ্ঞাপনে টানা হচ্ছে শিক্ষার্থী
** অননুমোদিত স্কুলের সংখ্যা জানে না ডিপিই
** থমকে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স

‘এলাকায় বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেই, তা দেখে সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকরা আসেন। ফি নিয়ে ভর্তি করানো হয়। এরপর ক্লাস-পরীক্ষা চলে। স্কুল চালাতে আবার অনুমোদন কীসের? কই, আশপাশে কেউই তো অনুমোদন নেয়নি। তারাও স্কুল চালাচ্ছেন, আমিও চালাচ্ছি।’

উষ্মা প্রকাশ করে এ কথা বলছিলেন ঢাকা স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ফকরুল হোসেন সবুজ। তিনি নিজেকে স্কুলটির অধ্যক্ষ পরিচয় দেন। নিজের ভিজিটিং কার্ডেও তিনি এ পদবি ব্যবহার করেন। নিজেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল সংশ্লিষ্ট একাধিক সংগঠনের নীতিনির্ধারক বলেও দাবি করেন ফকরুল। রাজধানীর ৩৬/৫ উত্তর আদাবরে ২০০৯ সালে তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফকরুলের দাবি—‘এলাকায় তার স্কুলের অনেক সুনাম। সবাই এক নামে চেনে।’

তবে খোঁজ-খবর নিয়ে মেলে ভিন্ন চিত্র। তিনতলা একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় চলছে স্কুলটির কার্যক্রম। প্লে-গ্রুপ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। আশপাশে বসবাস করা কয়েকজন নারীকে দিয়ে দায়সারা ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া হয়। শিক্ষকদের অধিকাংশই এসএসসি পাস। তারাই স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির ক্লাস নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলটির একজন চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক বলেন, ‘বরিশাল থেকে এসএসসি পাস করেছি। এরপর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আমরা আদাবরে ভাড়া বাসায় থাকি। কাজ-কর্ম নেই, সারাদিন বাসাতেই থাকা হয়। এজন্য দুই বছর আগে এ স্কুলে চাকরি নিয়েছি। মাসে চার হাজার টাকা বেতন।’

তিনি বলেন, ‘অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি ও বাংলা ক্লাস নিতে হয়। বাড়িতেও কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াই। সেখান থেকে কিছু টাকা আসে।’

তার মতো এ স্কুলে আরও চারজন শিক্ষক রয়েছেন, যারা পরিবারের কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে ক্লাস নেন।

ঢাকা স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বিলকিস বেগম। তিনি জাগো নিউজ বলেন, ‘স্কুলে ভর্তি করানোর আগে অধ্যক্ষ (ফকরুল হোসেন সবুজ) দাবি করেন, তাদের সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি ফি নিয়েছেন আট হাজার টাকা।’

স্কুলের পরিবেশ ভালো না হলেও বাসার পাশে হওয়ায় তিনি মেয়েকে এখানে ভর্তি করেছেন বলে জানান বিলকিস।

jagonews24অনুমোদন ছাড়াই চলছে উত্তর আদাবরের ঢাকা স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল/ছবি: জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘ভর্তির পর দেখি ভালো কোনো শিক্ষক নেই। অধিকাংশ শিক্ষকই এসএসসি পাস কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ হয়। স্কুলের মালিক ও শিক্ষকরা নানা ধরনের মিথ্যা কথা বলে শিক্ষার্থী ভর্তি করান। পরে সত্যটা জানতে পারলেও আর কিছু করার থাকে না।’

এ অভিভাবকের প্রশ্ন, ‘অনুমোদন ছাড়া যুগের পর যুগ কীভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে? সরকারের দায়িত্বশীলদের কি এসব চোখে পড়ে না?’

কাউন্সিলর স্কুল কমিটির সভাপতি, সংকট হয় না শিক্ষার্থীর
ঢাকা স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাশেই অবস্থিত আদাবর আইডিয়াল স্কুল। আদাবর ৭১/১ নম্বরের পাঁচতলা একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় ২০০৪ সাল থেকে চলছে স্কুলটি। প্লে-গ্রুপ থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থী ২৩৫ জন। তাদের জন্য রয়েছেন ১২ জন শিক্ষক। অনুমোদনহীন অন্য স্কুলগুলোর মতো এখানেও গৃহিণী ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। তাদের যেমনি নেই শিক্ষাগত যোগ্যতা, তেমনি কোনো প্রশিক্ষণও পাননি তারা।

আদাবর আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাজনীন নাহার বলেন, ‘করোনার আগে স্কুলে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ছিল। মাঝে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী চলে গেছে। বর্তমানে ২৩৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। চুক্তিভিত্তিক কিছু শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’

সহকারী প্রধান শিক্ষকের দাবি, ‘স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এজন্য তাদের স্কুলে কখনো শিক্ষার্থীর সংকট হয় না।’

ঠিক একইভাবে চলছে অনুমোদনহীন গ্রিন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও। এটি ৫২৬/এ, আদাবর ১২ নম্বর রোডে অবস্থিত। ২০০৯ সালে চালু হওয়া স্কুলটিতে প্লে-গ্রুপ থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ানো হয়। একই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষাও চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে মোট শিক্ষার্থী ২৪৫ জন। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের শিক্ষার্থীরাই এখানে শিক্ষকতা করছেন। স্কুলটি ধার করা রেজিস্ট্রেশনে চলছে। মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এমপিওভুক্ত প্রেসিডেন্সি হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও শাপলা একাডেমি থেকে থেকে জেএসসির শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান।

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষক!
ফার্মগেট পূর্ব রাজাবাজার ১৫১/২ মসজিদ রোডের গলিতে অবস্থিত সানফ্লাওয়ার স্কুল। এখানে বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়াম চালু রয়েছে। আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় তিনটি শ্রেণিকক্ষ। ছোট ছোট কক্ষে গাদাগাদি করে বসানো হয়। শিক্ষার্থী তিন শতাধিক। শিক্ষক মাত্র ৮ জন। সকালে বাংলা-ইংরেজি মাধ্যমের প্রাথমিকস্তর এবং দুপুরে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। অনুমোদন ছাড়াই প্রায় দেড় দশক ধরে চলছে স্কুলটি।

jagonews24আদাবর আইডিয়াল স্কুলে পাঠদান চলছে অনুমোদন ছাড়াই/ছবি: জাগো নিউজ

শ্রেণিকক্ষে ঢুকে দেখা যায়, মৌ নামে একজন শিক্ষক সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি তেজগাঁও কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিন বছর ধরে তিনি এ স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরই তিনি চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন এখানে। ক্লাস নেন বাংলা ও ইংরেজি দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরই।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান অবশ্য দাবি করেন তার প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মান ভালো। সেজন্য বিজ্ঞাপন না দিলেও শিক্ষার্থীর অভাব হয় না। তবে কোনো স্তরেরই অনুমোদন নেই বলে স্বীকার করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্ত একটি স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে থাকি। সেখান থেকেই তারা পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়।’

অননুমোদিত স্কুলের সংখ্যা জানে না ডিপিই
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্রে জানা গেছে, কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধন পেতে তিনটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথম ধাপে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রাথমিক অনুমতির আবেদন করতে হয়। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক বরাবর আবেদন করতে হয়। উপ-পরিচালক সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিকভাবে ডিপিইতে সুপারিশ পাঠান। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে অস্থায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। এরপর সেখান থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। অস্থায়ী নিবন্ধন পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে চূড়ান্ত পর্বে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। পাঁচ বছর পরপর এ নিবন্ধন নবায়ন করা বাধ্যতামূলক।

ডিপিই সূত্রে গেছে, সারাদেশে এ পর্যন্ত ৩৫০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলকে অস্থায়ী অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আরও ৭০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলকে অনুমোদন দিতে বিভাগীয় পর্যায় থেকে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ৫৩টি, রাজশাহীতে ছয়টি, রংপুরে দুটি, বরিশালে চারটি এবং চট্টগ্রামের পাঁচটি স্কুল রয়েছে। এর বাইরে ৪৫০টি আবেদন পড়ে রয়েছে। সেগুলো ক্রটিপূর্ণ হওয়ায় নতুন করে তথ্য সংযুক্ত করতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

যদিও সংশ্লিষ্ট সংগঠকদের দাবি, সারাদেশে ৬০ হাজারের বেশি স্কুল অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে। নীতিমালা না হলে দিনে দিনে এমন প্রতিষ্ঠান বাড়বে, বাড়বে শিক্ষাকেন্দ্রিক বাণিজ্য।

থমকে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) প্রাক-প্রাথমিক বিভাগের উপপরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের অলিগলিতে অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। অনেকে আবার কিন্ডারগার্টেনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরও চালু করছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আমাদের জানা নেই। আমরা সবমিলিয়ে সাড়ে তিনশো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছি। আরও কিছু আবেদন এসেছে, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ঝুলে আছে।’

jagonews24অনুমোদন ছাড়া চলছে গ্রিন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কার্যক্রম/ছবি: জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘অবৈধ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তিন বছর আগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি পাঠিয়ে অবৈধ এমন কিন্ডারগার্টেন-স্কুলের বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল। মাত্র ১০-১২টা জেলা থেকে তথ্য পাঠানো হয়েছিল। অন্যরা সময়মতো পাঠাতে পারেননি। এরমধ্যে আবার মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়ে যায়। ফলে অবৈধ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগে ভাটা পড়ে।’

সমস্যা নিরসনে শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন জরুরি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের জনবল দরকার, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নেই। দায়িত্বে যারা আছেন, তারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে চোখ বন্ধ রাখেন। সেই সুযোগে অবৈধ স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে। এসব নিয়ন্ত্রণে একটি শিক্ষা আইন তৈরি করা হলেও তা ২০১৩ সাল থেকে ঝুলে আছে। বিভিন্ন সময়ে সংসদীয় কমিটিতে উঠলেও তা ঝুলে যাচ্ছে। অনেক ধরনের স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে প্রভাবিত করে শিক্ষা আইন আটকে রেখেছেন।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের শিক্ষা আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কিন্ডারগার্টেন অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে এবং সরকারের কারিকুলাম অনুসরণ করতে হবে। শিশুদের কাঁধে বাড়তি বইয়ের বোঝা তুলে দেওয়া যাবে না। অথচ আট বছরেও তা বাস্তবায়নের পথে যাওয়া যায়নি। শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন হলে ভুঁইফোড় স্কুল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। মাননিয়ন্ত্রণের জায়গাটা অন্তত তৈরি হতো।’

এমএইচএম/এএএইচ/এইচএ/জিকেএস

আরও পড়ুন