দুবার পরীক্ষা স্থগিত, গচ্চা সোয়া ২ কোটি টাকা!
জনবল নিয়োগে পরপর দুবার পরীক্ষার আয়োজন করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এজন্য কেন্দ্র-পরীক্ষক নির্ধারণ ও প্রশ্নপত্রও ছাপানো হয়। দুবারই ‘অনিবার্য কারণে’ পরীক্ষা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। স্থগিতের খবর শুধু বিজ্ঞপ্তিতে জানানোয় কয়েক হাজার প্রার্থী হাজির হন পরীক্ষা কেন্দ্রে। ভোগান্তিতে পড়েন সাড়ে ছয় লাখের বেশি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা না হলেও এ বাবদ প্রায় দুই কোটি ২১ লাখ টাকা খরচ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ঘটনা ঘটেছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) স্থায়ী রাজস্ব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালে একবার এ পদে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল। সবশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর পরীক্ষার ঠিক আগের দিন ফের স্থগিত করা হয়।
চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, সাধারণত কোনো অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি পরীক্ষার্থীদের মেসেজের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজসেবা অধিদপ্তর পরীক্ষার্থীদের কোনো মেসেজ দেয়নি। শুধু পরীক্ষার আগের দিন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরীক্ষা স্থগিতের তথ্য জানিয়ে দায় সেরেছে। কিন্তু কী কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে, তা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ নেই। কর্তৃপক্ষের এমন গাফিলতিতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বারবার নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হচ্ছে। অথচ সংস্থাটিতে তীব্র জনবল সংকট রয়েছে। ব্যাঘাত ঘটছে সংস্থাটির নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায়। মানুষ পর্যাপ্তসেবা পাচ্ছে না। তাই প্রশ্নফাঁস চক্রসহ অন্যান্য নেতিবাচক কার্যক্রম বন্ধে সোচ্চার হচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করতে দেশের দুস্থ, অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, দরিদ্র, এতিম ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ নারী ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তিসহ সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে এই অধিদপ্তর। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে কাজ করেন ইউনিয়ন সমাজকর্মীরা। কিন্তু দীর্ঘদিন সমাজকর্মীর পদ শূন্য থাকায় এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরে জনবল কাঠামো অনুযায়ী ১২ হাজার ৯৮৫টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৭০২টি পদ শূন্য। সমাজকর্মী পদ তিন হাজার ২০০টি, এর মধ্যে খালি ৭৯৯টি। এসব পদ পূরণে ২০১৮ সালের ১১ জুলাই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। তাতে আবেদন করেন ছয় লাখ ৬২ হাজার ২৭০ জন চাকরিপ্রার্থী। ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তাদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। এজন্য ৬৩০টি পরীক্ষাকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়। পরীক্ষা নিতে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগকে। কিন্তু পরে প্রশ্নফাঁসের অজুহাতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
পরে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ওই স্থগিত পরীক্ষা নিতে ফের সময় নির্ধারণ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। কিন্তু পরীক্ষার মাত্র একদিন আগে ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে তা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। অথচ পরীক্ষাটি নেওয়ার জন্য ৩৭৩টি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরীক্ষা দিতে এসে এসব কেন্দ্র থেকে ফিরে গেছেন অনেক চাকরিপ্রার্থী।
সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) পদে চাকরি পেতে আবেদন করেছেন হবিগঞ্জের জামান সরদার। সম্প্রতি তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার খবর জানতাম না। কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার মতো হাজারো পরীক্ষার্থী কেন্দ্রের সামনে ভিড় করেছেন। তারাও পরীক্ষার খবর জানতেন না। কিন্তু কী কারণে পরপর দুবার এই পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে, তা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মনে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। অনেকেরই ধারণা, এর পেছনে হয়তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
জামান আরও বলেন, এই পদে চাররিপ্রার্থীদের অনেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। এতে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তারা।
অবিলম্বে স্বচ্ছভাবে এই পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানান এই চাকরিপ্রত্যাশী।
গত ২৪ ডিসেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ও বিভাগীয় নিয়োগ কমিটির সভাপতি সৈয়দ মো. নূরুল বাসির স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা স্থগিতের তথ্য জানানো হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে শুধু বলা হয়েছিল, অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু অনিবার্য কারণ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে জানতে গত ১২ জানুয়ারি সৈয়দ মো. নূরুল বাসিরের ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) স্থায়ী রাজস্ব’ পদের নিয়োগ পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন চাকরির গ্রুপে একটি প্রশ্নের অর্ধেক অংশ শেয়ার করেন অনেকে। এরপর পরীক্ষা স্থগিত করতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফেসবুকের এই প্রশ্নের সঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রশ্নের কোনো মিল ছিল না। এখন তৃতীয়বার পরীক্ষার আয়োজন করতে আরও এক কোটি টাকা খরচ হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯ ও ২০২১ সালে এই পরীক্ষা আয়োজনে প্রায় দুই কোটি ২১ লাখ টাকা খরচ করেছে অধিদপ্তর। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অথচ বর্তমানে সরকারি ভাতাভোগী আছেন প্রায় এক কোটি ৫ লাখ। এ খাতে চলতি বছর বাজেটে সাত হাজার ১০৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। চলতি অর্থবছর ১৫০টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলাসহ ২৬৩টি উপজেলায় শতভাগ দরিদ্র, বয়স্ক ও বিধবাদের ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভাসমান জনগোষ্ঠীর ভাতা, উপবৃত্তি, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের কর্মসূচি, চা শ্রমিককে আর্থিক সহায়তা, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান, রুরাল সোশ্যাল সার্ভিস (আরএসএস) কার্যক্রম, দুস্থ-সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের যত্ন-পরিচর্যা, সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ, বিনোদন ও অধিকার সুরক্ষা, সরকারি শিশু পরিবার, ছোটমণি নিবাস, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, দিবাকালীন শিশু যত্নকেন্দ্র, দুস্থ শিশুদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং এতিমখানার কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করেন ইউনিয়ন সমাজকর্মীরা। নিয়োগ ঝুলে থাকায় সংস্থাটির সেবা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এখন নতুন করে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়নি। হলে এসএমএস ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন সমাজকর্মীর অনেক পদ শূন্য। যে কারণে আমাদের কাজে সমস্যা হচ্ছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবাদানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের বিষয়ে শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ফেসবুকে যে প্রশ্নপত্র ছড়িয়েছে সেটির সঙ্গে অধিদপ্তরের প্রশ্নপত্রের কোনো মিল নেই। এমনকি মানবণ্টনের কোনো মিল ছিল না। পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার ফোন পরীক্ষার দুদিন আগে থেকে বন্ধ ছিল। ফলে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ সত্য নয়।
এমএমএ/কেএসআর/এএ/এএসএম