একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক : ফ্রি চিকিৎসা নিচ্ছেন দরিদ্র কোটায়
ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক, তবুও ‘হতদরিদ্র কোটায়’ বারডেম হাসপাতালে নিচ্ছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যের চিকিৎসা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্ডধারী রেজিস্ট্রার্ড এ সকল কথিত দরিদ্র শত শত ডায়াবেটিস রোগী বছরের পর বছর ধরে বারডেম হাসপাতালের বেড, ইনসুলিনসহ দামি ওষুধ ইনজেকশন, অস্ত্রোপচার, আইসিইউ ও সিসিইউতে ফ্রি চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকৃত মোট রোগীর সংখ্যা নির্ণয় তথা এ ধরনের কথিত দরিদ্র রোগী চিহ্নিত করতে যাচাইবাছাই কার্যক্রম শুরু করেছে বারডেম কর্তৃপক্ষ। কার্ডধারী রোগীদের প্রত্যেককে চিঠি পাঠিয়ে ছয়সদস্যের বোর্ডের সামনে নির্দিষ্ট দিনে সশরীরে হাজির হয়ে সাক্ষাৎকার দিতে হাজির হতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে কার্ডধারী ব্যক্তির প্রকৃত আয়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই শতাধিক রোগী সাক্ষাৎকারে বোর্ড সদস্যদের কাছে একসময় সাহায্য নিলেও এখন আর তিনি সাহায্য নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এছাড়াও আরো শতাধিক ব্যক্তি নির্দিষ্ট দিনে সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বারডেম হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এদের প্রায় সকলেই ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি গাড়ির মালিক। হয়তো এক সময় গরিব ছিলেন কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তারা। কিন্তু বারডেম হাসপাতালের এ উদ্যোগের আগে তারা সকলেই হতদরিদ্র হিসেবে বিনামূল্যের চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব ও হাসপাতাল পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহিদুল হক মল্লিক।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, বারডেম হাসপাতালে বর্তমানে যে হাজার হাজার ডায়াবেটিস রোগী সম্পূর্ণ বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন তাদের অনেকেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েও হতদরিদ্র কোটায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। ব্যয় সংকোচন তথা প্রকৃত সাহায্য প্রয়োজন এমন রোগীর সংখ্য নির্ণয়ে তারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলেও জানান তিনি।
১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ডা. মো. ইব্রাহিমের উদ্যোগে বারডেম হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। ডা. ইব্রাহিমের স্বপ্ন ছিল টাকার অভাবে যেন একজন ডায়াবেটিক রোগীও ফিরে না যায়। তিনি বেঁচে থাকতেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাহায্যার্থে গড়ে তুলেন বারডেম হাসপাতাল।
চুক্তি অনুযায়ী বারডেম কর্তৃপক্ষ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্ডধারী হতদরিদ্র শতকরা ৩০ ভাগ রোগীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার জন্য রাজি হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দরিদ্র কোটায় কার্ডধারী রেজিস্ট্রার্ড রোগীর সংখ্যা ৭০ হাজার। নীতিমালা অনুসারে যে সকল পরিবারের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা নীচে সে সকল ডায়াবেটিস রোগী সমাজকল্যাণের সাহায্য পাওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত অর্থবছরে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসাবাবদ শুধুমাত্র ওষুদেই বছরে খরচ হয় ৪২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বারডেম হাসপাতাল সরকারি অনুদান পেয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।
বারডেম সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর এ চার মাসে মোট ১৯ কোটি ২৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা সমাজকল্যাণ তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে।
যেভাবে উন্মোচিত হচ্ছে দরিদ্র নামধারী ধনীদের মুখোশ
বারডেম হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, বারডেম হাসপাতাল সরকারি নিয়মনীতি অনুসারে বেতনভাতা প্রদান করে। সম্প্রতি সরকারি বেতনস্কেল বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তাই অযাচিত খরচ কমাতে তারা বিনামূল্যে সাহায্যপ্রার্থী রোগীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়।
হাসপাতালের পরিচালক শহিদুল হক মল্লিক জানান, ছয়মাস আগে বারডেম কর্তৃপক্ষ বোর্ড গঠন করে সাহায্যপ্রাপ্ত রোগীর সঠিক সংখ্যা নিরূপণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাকে প্রধান ও সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নিলুফার নাহারকে সদস্যসচিব করে ছয় সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়।
কমিটির অন্যান্যরা হলেন; অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) সিরাজদৌলা, যুগ্ম পরিচালক (অর্থ) ফজলে রাব্বি, উপ পরিচালক (হাসপাতাল) নাজিমউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক (সমাজকল্যাণ) রাশেদুল ইসলাম।
শহিদুল হক মল্লিক জানান, ইতোমধ্যেই তারা ৭০ হাজার রোগীর সকলকে চিঠি পাঠিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বোর্ডের সামনে রেজিস্ট্রার্ড কার্ড নিয়ে হাজির হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। কেউ হাজির না হলে তাদের সাহায্য স্থগিত রাখা হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়।
জানা গেছে, গত তিনমাস আগে শুরু হওয়া সাক্ষাৎকারে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ হাজার ডায়াবেটিস রোগীর বোর্ডের সামনে হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে শতাধিক এখন আর সাহায্য না হলেও চলবে বলে জানান। আরো শতাধিক নির্দিষ্ট দিনে হাজির হননি। প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন থেকে ৪০ জন রোগীর সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিনামূল্যের এ চিকিৎসার সাথে বারডেম হাসপাতালের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। তারা গোপন কমিশনের চুক্তিতে গত কয়েকবছর যাবৎ বিত্তবান অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগীকে সমাজকল্যাণের কার্ড পেতে সাহায্য করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, তার পরিচিত একজন অ্যাডভোকেট যিনি ২৬শ’ বেডের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার ছিলেন তিনি সমাজকল্যাণ দরিদ্র কোটায় ফ্রি চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রথমে তাকে সাহায্যপ্রার্থীর লাইনে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
কি কারণে বোর্ড গঠিত হয়েছে, এর মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি করতে চাইছে জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক শহিদুল হক মল্লিক বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাহায্যপ্রাপ্ত রোগীদের কেউ হাসপাতালে মারা গেলে তারা জানতে পারেন। কিন্তু বাসা-বাড়িতে কেউ মারা গেলে তারা জানতে পারেন না। এ পর্যন্ত ৭০ হাজার কার্ডধারী রোগীর মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অনেকে দীর্ঘদিন যাবৎ সাহায্য নিতে আসেন। প্রকৃত সাহায্যপ্রার্থীও সংখ্যা নিরূপণে তারা মূলত কাজটি করছেন।
তিনি বলেন, গত দুই দশকে সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যে অনেকেরই আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। নিজে ও ছেলেমেয়েরা সমাজের বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের এখন আর সাহায্যের হয়তো প্রয়োজনই নেই। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই তাদের বদলে প্রকৃত একজন দরিদ্র সাহায্য পেলে উপকৃত হবে বলে মনে করেন।
এমইউ/এসএইচএস/এসকেডি/পিআর