ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

একটি কবরের সন্ধানে ৫০ বছর!

সালাহ উদ্দিন জসিম | প্রকাশিত: ০৭:৩৯ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হলো। কিন্তু যাদের হাত ধরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া এখনো বিতর্কমুক্ত হয়নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফাঁক গলে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে সনদ নিয়েছেন। ভাতাও নিচ্ছেন অনেকে। এ নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই। কিন্তু প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও তাদের কবর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কবর চিহ্নিত না হওয়া এমনই এক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মো. মুমিনুল হক।

মা-বাবা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সিপাহী মমিনুল হক। দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুমিনুল হককে স্বীকৃতি দেন, তার পরিবারকে চিঠিসহ ভাতাও দেন। কিন্তু পরের বছরগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো স্বীকৃতি পাননি মমিনুল হক। বরং এ রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতিকেও অস্বীকার করছেন। মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া মমিনুল হকের সন্তান এখন তার বাবার কবর ও স্বীকৃতির খোঁজে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

jagonews24এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকডসের রেজিস্টারে সিপাহী মো. মুমিনুল হকের কাগজপত্র/ছবি: জাগো নিউজ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার কচুয়ার সাহারপাড় গ্রামের সন্তান সিপাহী মো. মমিনুল হক বিমানবাহিনীর চতুর্থ এমওডিসি (আইডি নাম্বার ৮৮০৭৯২৩) পিএএফে কর্মরত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহ্বানে বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সালদা নদীর পাড়ে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে শহীদ হন মমিনুল হক। কল্যা পথর নামক জায়গায় তাকে দাফন করা হয়। তার কমান্ডার ছিলেন মেজর এ টি এম হায়দার।

যদিও এ খবর জানতেন না শহীদ মমিনুল হকের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ও বয়স্ক বাবা-মা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার ফেরার পথ চেয়েছিলেন তারা। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠি পাঠান মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীর কাছে। যেটি ছিল তার ছেলের যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি বা শোকবার্তা। চিঠির সঙ্গে ছিল দুই হাজার টাকার একটি চেক। চাঁদপুর জেলা (মহকুমা) প্রশাসক আইয়ুব কাদেরীর কাছ থেকে শহীদ মুমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলী ওই চিঠি ও চেক (নং ডিই-এ ২৯১৫৭৬, তারিখ ০১-০৮-১৯৭২ ইং) গ্রহণ করেন।

jagonews24শহীদ মমিনুল হকের ছেলে এমরান হোসেনের মানবাধিকার কমিশন বরাবর পাঠানো চিঠি ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবা ওয়াহেদ আলীকে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর পাঠানো চিঠি/ছবি: জাগো নিউজ

এই চেক নেওয়ার জন্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসক আইয়ুব কাদেরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীকে দেওয়া হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মমিনুলের স্ত্রীর পেনশনের জন্য দুই কপি ছবি চেয়ে রেকর্ড অফিস থেকে টেলিগ্রামে বার্তাও দেওয়া হয়।

এসব ছাড়াও রেকর্ড অফিসের অনেক প্রমাণাদি থাকলেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের তালিকায় নাম নেই মমিনুল হকের। মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমরান হোসেন পাচ্ছেন না সেই স্বীকৃতির খোঁজ।

এমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে আমার জন্ম। আমি মাতৃগর্ভে থাকতেই বাবা যুদ্ধে যান এবং শহীদ হন। বাবার শাহাদতের খবরে দাদা পাগলের মতো হয়ে আত্মহত্যা করে (বাসের নিচে মাথা দিয়ে) মারা গেছেন। নানা সংকটে মায়ের কোলেই বেড়ে উঠেছি। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবার কবর খুঁজছি। শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি।’

jagonews24শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিনুল হকের ছেলে এমরান হোসেন/ছবি: জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘অনেক সন্ধানের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বাবার কবর (অজ্ঞাত) খুঁজে পেলেও জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া দাবি করতে পারছি না। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বীকৃতিপত্র ও মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স কনস্ট্যাবিউলারির (এমওডিসি) পরিচয়পত্র নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর অফিসে গিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’

কী কারণে কাজ হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা সময় মন্ত্রণালয় বলছে বিমানবাহিনীর প্রত্যয়নপত্র লাগবে। বিমানবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছেন, আমাদের নথিতে আপনার বাবার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তখন কর্মকর্তাদের মুখের ওপর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছি, তাহলে বঙ্গবন্ধুর এই চিঠি, বিমানবাহিনীর চিঠি ও আইডি কার্ড সবই কি ভুয়া? তারা জবাব দিতে পারেননি । বেশি কথা বললে রাগান্বিত হন। বেরিয়ে যেতে বলেন।’

‘সর্বশেষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেছি। তারা এমওডিসি রেকর্ডসের প্রতিবেদন চেয়েছে। অবশ্য এ বছরে (২০২১) এমওডিসি তাদের নথিতে বাবার সব তথ্য খুঁজে পেয়েছে এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বাবাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছে।’

jagonews24মুক্তিযুদ্ধের আগে সিপাহী মমিনুল হকের পিএএফে কর্মরত থাকার প্রমাণপত্র/ছবি: জাগো নিউজ

এমরান হোসেন বলেন, ‘আমি চাই শুধু বাবার কবর চিহ্নিত করে দিক, যেন অন্তত জিয়ারত করতে পারি। আর বাবা যে দেশের জন্য জীবন দিলেন সেই স্বীকৃতিটা দিক।’

৫০ বছরেও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়া দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাবেন না, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা সব সময় বলে আসছি, টানা ১১ বছর এ সরকার ক্ষমতায় আছে, অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা তৈরি করতে পারলো না, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা স্বীকৃতি-সম্মাননা দিতে পারলো না। এটা খুবই দুঃখজনক। তবে এটা কেন হয়নি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’

 

jagonews24ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সম্মুখযুদ্ধে পাক হানাদারের গুলিতে শহীদ হন মমিনুল হক। কল্যা পথর নামক জায়গায় তাকে দাফন করা হয় বলে জানা যায়/ফাইল ছবি

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল বলেন, ‘যদি উনি সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি করে থাকেন, তাহলে আমাদের কাছে দরখাস্ত দিলে আমরা সশস্ত্র বাহিনীর কাছে জানতে চাইবো। সশস্ত্র বাহিনী যদি তথ্য দেয়, তাহলে আমরা মিটিংয়ে তুলবো। মিটিংয়ে সেটার সিদ্ধান্ত হবে।’

তার পরিবারের পক্ষ থেকে জামুকায় আবেদন করা হয়েছে জানালে মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাকে তো আবেদনটা দেখাতে হবে। দেখায়েন। দেখলে বুঝতে পারবো, ঘটনাটা কী?’

jagonews24

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহীদ দুই ধরনের; একটি গণশহীদ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। গণশহীদ হলে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বীকৃতিই যথেষ্ট। আর কিছু লাগে না। আর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলে আমাকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। উনি আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা অনুসন্ধান করে দেখবো। অথবা সশস্ত্র বাহিনী যদি প্রত্যয়নপত্র দেয়, তাহলেও আমরা বিবেচনা করবো।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে, তারা এরই মধ্যে এমরান হোসেনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য ‘এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকর্ডস’কে দিয়েছে। ‘এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকর্ডস’ তাদের প্রতিবেদনে মমিনুল হককে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি মমিনুল হকের চাকরি ও যুদ্ধে যাওয়ার সব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। ওই সব তথ্য ও সুপারিশসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মমিনুল হককে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চিঠি দেবে কমিশন।

এসইউজে/এআরএ/এএসএম