মুজিবনগরে হবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য উদ্যান
স্বাধীন বাংলাদেশের সুতিকাগার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল জায়গাটির নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’। ঐতিহাসিক এ স্থানে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির বিবরণ সংবলিত ইতিহাস পরিক্রমাসহ ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য উদ্যান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় আরও থাকবে ম্যুরাল ও পেইন্টিং স্থাপন। ’৫২ থেকে ’৭১ পর্যন্ত পটপরিবর্তনের চিত্র থাকবে এসব শিল্পকর্মে।
প্রকল্পের আওতায় সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন হবে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক এ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা কমিশনে। যার মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০৯ কোটি ৯ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ২০ মে প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন আল রশিদ। পিইসি প্রকল্পের বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পুনর্গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠন করে ৮ ডিসেম্বর ফের পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেলে প্রকল্পটি চার বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, শেখ হাসিনা মঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি সম্বলিত ডিওরমা নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে হবে একটি ভাস্কর্য উদ্যান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য রবীন্দ্র সরোবরের আদলে নির্মাণ করা হবে একটি অবকাঠামো।
প্রকল্প প্রসঙ্গে পিইসি সভা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানায়, প্রকল্পের আওতায় ৫১ একর জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৬৫ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জমির মূল্য সংক্রান্ত ডকুমেন্ট ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংযুক্ত করা হয়নি। এছাড়া ১৮ হাজার ৮২৫ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণ বাবদ ৭৫ কোটি ৯ লাখ এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৩ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণ বাবদ ১৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এছাড়া ২৪টি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য নির্মাণ বাবদ ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ৭৫টি পেইন্টিং, ম্যুরাল, ডিওরমা ও মানচিত্র বাবদ ১৫ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুতায়ন খাতে ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অধিক মর্মে প্রতীয়মান হয় বলে দাবি পরিকল্পনা কমিশনের।
আইটসোর্সিং খাতে ২৯৪ জনমাসের জন্য ৫২ লাখ ৯২ হাজার টাকা এবং অফিসার ও কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৬৩ লাখ এবং ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের রাজস্ব অংশে ভ্রমণভাতা খাতে ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, অফিস ভাড়া বাবদ ৭৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বিদ্যমান স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা, বীজ ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ খাতে তিন কোটি টাকা, কনসালটেন্সি খাতে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলধন খাতে আছে বৃক্ষ ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ বাবদ দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। এসব ব্যয়ের যৌক্তিকতা বিষয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। এছাড়া বৈদেশিক ভ্রমণের প্রশিক্ষণ শিক্ষা ভ্রমণের জন্য ৬০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তাও আলোচনা করা হয়। বিষয়গুলো সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি আবারও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (পরিকল্পনা) আবুল বাকের মো. তৌহিদ জাগো নিউজকে বলেন, এর আগে একবার প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিলাম। পরে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভা আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের প্রবাসী সরকার মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে ১৭ এপ্রিল শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। ১৯৭৩ সালের ৩১ আগস্ট সরকার মুজিবনগরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেয়। ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে যায়। এরপর এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালে মুজিবনগরে স্মৃতিসৌধের কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বরাদ্দ করা হয় প্রায় দুই কোটি টাকা। ২০ দশমিক ১০ একর জমি নিয়ে ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ স্তম্ভের সমন্বয়ে এ স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্থপতি তানভীর কবির এর নকশা করেন। এ সৌধটিকে উদীয়মান সূর্যের প্রতীক বলা হয়। ২৩টি স্তম্ভ পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনের প্রতীক। এই ২৩ বছরে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে যে সংগ্রাম গড়ে তোলে তার প্রতীকও ২৩টি স্তম্ভ। ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় ১৬০ ফুট ব্যাসে বেদিটি নির্মিত। বেদির অর্ধাংশে স্তম্ভগুলো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার বেদির অপরাংশ অসংখ্য গোলাকার বৃত্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে বোঝানো হয়েছে। তিন ফুট উচ্চতার বেদির অপরাংশ অসংখ্য নুড়ি পাথরে আবৃত। এটি মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতীক। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণের স্থানটি লাল সিরামিকের ইট দিয়ে আয়তক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে। বেদিতে আরোহণের সোপান নয়টি ধাপে বিভক্ত। সোপানের এ নয়টি ধাপ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির প্রতীক।
কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, মুজিবনগর আমাদের সবার এলাকা। মুজিবনগরকে আমরা বুকে ধারণ করি। আমি চাই এটি ভালোমতো হোক। মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস এখানে স্থান করে নিক। সারাদেশের মানুষ যেন এখানে সহজেই যাতায়াত করতে পারে সেজন্য সংযোগ সড়ক তৈরির বিষয়েও তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এখানে স্বাধীনতার প্রতিবিম্ব দৃষ্টিনন্দন হোক। এছাড়া ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরের মতো একটা স্থাপনা নির্মাণ করা জরুরি। যাতে এখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক হতে পারে। এটা চমৎকারভাবে বাস্তবায়নের জন্যই মূলত এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্যই পিইসি সভায় সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।
এমওএস/এএ/জেআইএম