রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফ চেয়ে আবেদন করতে পারবে কে?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করে তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের আদেশ দিতে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একাংশ। গত ২২ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ১১ আইনজীবী ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেন।
রাষ্ট্রপতির কাছে করা ওই আবেদনটি নিষ্পত্তি করতে ২ ডিসেম্বর আবারও আবেদন করেন সেই ১১ জন আইনজীবী। সেখানে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনটি সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবিক দিক বিবেচনায় নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ করা হয়।
এখন আলোচনা চলছে এ বিষয়ে যে, সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির হয়ে অন্য কোনো ব্যক্তি বা আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা বাতিল বা স্থগিতের জন্য অথবা ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করতে পারেন কি না। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী মতামত দিয়েছেন জাগো নিউজের কাছে।
আইনজীবীরা বলছেন, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ হলো সাজা হ্রাস, স্থগিত বা ক্ষমা সংক্রান্ত। কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে। কিন্তু সেই আবেদনটা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই করতে হবে। আর সেই আবেদনের বিষয়ে আসামিকে সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোনো আইনজীবীর আবেদন করার সুযোগ নেই। তবে আইনজীবী যদি ড্রাফট (খসড়া) করেন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু মূল আবেদনে স্বাক্ষর করবেন আসামি নিজে।
রাষ্ট্রপতির কাছে বিএনপিপন্থী ওই আইনজীবীদের ওই আবেদনে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে। যে ক্ষমতা সংবিধান আপনাকে দিয়েছে। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষায় সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করে বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করে বাঁচার সুযোগ দিন।’
এছাড়া, মানবিক কারণে চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছেও স্মারকলিপি দেয় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের অপর একটি প্রতিনিধি দল। গত ২৩ নভেম্বর সচিবালয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্যসহ ১৫ জন বিএনপিপন্থী আইনজীবী মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই স্মারকলিপি দেন।
এরপর ৫ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিএনপির আইনজীবীদের আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা আইনজীবীদের কাছ থেকে একাধিক আবেদন পেয়েছি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ আইনে আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার বিষয়ে এর আগের আবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়া সত্ত্বেও এখন আবেদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে না, এর কারণ জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রথম কথা আমি যেটা বলবো, আপনারা যেটা বলছেন যে পড়ে রয়েছে, আসলে এটা পড়ে থাকেনি। কথাটা হচ্ছে, এর আগের দু’বার আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছিল এবং আইনিভাবেই করা হয়েছিল। এখন অনেক পক্ষ থেকেই আবেদন এসেছে। আইনের কোনো ফাঁক, উপায় আছে কি না? সার্বিক দিক বিবেচনার পরই মনে হয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা উচিত।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া/ফাইল ছবি
‘সেক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন, সবসময় প্রধানমন্ত্রী মানবিক দিক দেখেছেন। আমাদের কথা হচ্ছে, আইনের কোনো ব্যত্যয় যেন না হয়। এবার যখন অনেক আবেদন এসেছে, আইনজীবীদের থেকেও আবেদনে এসেছে, সেজন্য সবকিছু ভেবে কিছু করা যায় কি না, এটার একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত আসা আমার মনে হয় সমীচীন। সেজন্য আমরা একটু সময় নিয়েছি’—বলেন আনিসুল হক।
দণ্ড বলতে কী বুঝায়
দণ্ডবিধি অনুযায়ী, একজন অপরাধীকে অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে বিচার সমাপনান্তে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক পাঁচ ধরনের দণ্ড দেওয়া যায়; মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যে কোনো মেয়াদে সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্তির দণ্ড ও অর্থদণ্ড।
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে।
এ ক্ষমতাটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দু’ভাবে প্রয়োগ করা হয়। এর একটি হলো বিচারিক আদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা হলে এবং অপরটি দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামিকে রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে সরকারের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শন। উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতাটি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ব্যতিরেকে সম্পন্ন করতে পারেন না।
আইনজীবীরা যা বলছেন
খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একটি অংশ রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছে। তারা আবেদন করতে পারেন কি না জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. ফজলুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে কে বা কারা আবেদন করেছে সেটি আমার জনা নেই।
রাষ্ট্রপতির কাছে যারা আবেদন করেছেন, তাদের একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মির্জা আল মাহমুদ। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তবে ‘সংগঠনবিরোধী তৎপরতার জন্য’ গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাকে বহিষ্কার করা হয়।
খালেদা জিয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন প্রসঙ্গে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দলীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয় আমি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি দলীয় কোনো বিষয় নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের বিষয়। মানবতার বিষয়। তাই জনস্বার্থে এই আবেদন করেছি।
আবেদনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে কি না এবং তার অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে মির্জা আল মাহমুদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা দেশের গণমাধ্যমে যে কোনো ধরনের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঘটনা জেনে তা নিয়ে আদালতে যান বা যেতে পারেন, সেই অধিকার তাদের আছে। জনস্বার্থে অনেক মামলাও হয়।
রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবন/ফাইল ছবি
‘এখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক। দেশের প্রতি গণতন্ত্রের প্রতি তার যে অবদান সেগুলো বিচার-বিবেচনা করে জনস্বার্থেই আমরা আইনজীবী হিসেবে এই আবেদন করেছি। রাষ্ট্রপতির কাছে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছে অনুযায়ী খালেদা জিয়ার দণ্ড বতিল কিংবা স্থগিতপূর্বক তাকে চিকিৎসার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরামর্শক্রমে বিদেশে পাঠানোর আর্জি জানিয়েছি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে আমরা যে আবেদন করেছি সেটা জনস্বার্থে। কিন্তু আমরা দণ্ড মওকুফের আবেদন করিনি।’
এ আইনজীবী বলেন, আমরা দণ্ড বাতিল অথবা স্থগিত চেয়েছি। পত্র-পত্রিকাসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ কিছু নয়, জনস্বার্থ এবং পত্রপত্রিকার নিউজের ভিত্তিতে এই আবেদন করেছি।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে চাইলে নিজে করবেন নাকি আইনজীবীর মাধ্যমে করবেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, অবশ্যই নিজে করতে হবে। প্রশ্নটা হলো যে কী চায় তারা। ক্ষমা করে কেন? বিদেশে যাওয়ার জন্য ক্ষমা করতে হবে এ ধরনের কোনো আইন তো নেই।
আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত যেই হোক, তার হয়ে আইনজীবীরা আবেদন করতে পারবেন এমন সুযোগ সংবিধানে আছে কি না, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত যেই হোক, সংবিধান বা আইন অনুযায়ী তাকেই (দণ্ডিত) রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করতে হবে। আইনজীবীরা করতে পারবেন না।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, কোনো আসামিকে যদি সাজা মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কছে আবেদন করতে হয় তাহলে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কিন্তু আসামিকেই করতে হবে। সেখানে আইনজীবীরা হয়তো সহায়তা করেন, ড্রাফটিং (খসড়া) লিখে দেন, সেক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আবেদনে আসামিকেই স্বাক্ষর করতে হবে। আসামি যখন স্বাক্ষর করবেন, সে আবেদনটা রাষ্ট্রপতির কাছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হবে। যথাযথ পন্থায় কারাগার থেকে (আবেদনটি) আসবে। রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পর তিনি সেটির ওপর সিদ্বান্ত দেবেন। যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই চূড়ান্ত। তার সাজা মওকুফ করবেন, না সাজা কমাবেন, না স্থগিত; যাই হোক সেটা তার সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুসারে করবেন।
এফএইচ/এমআরআর/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম