ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

আয়-ব্যয়ের টানাপোড়েনে ভালো নেই কুলিরা

রাসেল মাহমুদ | প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০২১

‘জীবন নামের রেলগাড়িটা পায় না খুঁজে ইস্টিশন, কোন লাইনে গেলে পাবে বলবে তারে কে এখন।’ মো. রাফিকুজ্জামানের লেখা ও মিতালী মুখার্জীর গাওয়া এই গানের কথার মতোই জীবনের ‘ইস্টিশান’ খুঁজে পাননি রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা গোলাম মোস্তফা।

জীবিকার তাগিদে জীবনের ৫০ বসন্ত এক লাইন থেকে অন্য লাইনে কাজের খোঁজে দৌড়েছেন কমলাপুরে কুলির কাজ করা এই মানুষটি। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় আসেন। তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলায় মানুষের কাজের সুযোগ ছিল কম। মোস্তফাও কোনো কাজ পাননি। অভাবের তাড়নায় যুদ্ধের সময় অনেকেই কুলির কাজ করতেন। সেই পথ ধরে মোস্তফাও হলেন কুলি। তখন মনপ্রতি ১ টাকা বা ২ টাকায় করে মাথায় জিনিসপত্র বহন করতেন। এখন তা হয়েছে ১৫ টাকা। তাও ১০-১৫ বছর আগে। আর এখন মাথায় না নিয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে গত ১৫ বছর ধরে কুলিরা ট্রলিতে করে এসব মালামাল বহন করছেন।

তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক ৬৭ বছর বয়সী গোলাম মোস্তফা। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। আগে পরিবার নিয়ে রাজধানীর গোপীবাগ ব্রিজ সংলগ্ন কুলি মহল্লায় থাকতেন। পরে টিটিপাড়ায় থাকা শুরু করেন। রেল কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে সরিয়ে দিলে স্ত্রীকে নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরে পাঠিয়ে দিয়ে এখন নিজে থাকেন গোডাউনে। সকাল ৭টা থেকে ৫টা পর্যন্ত গোডাউনের কাজ করেন। যখনই কাজ কম থাকে প্ল্যাটফর্মে ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে যান।

jagonews24

কেমন আছেন জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বেশি ভালা না। অভাবের কারণে এ কাজে আইছি। জীবনটা এহানেই কাটাইলাম। আগেই ভালা ছিল। ১০০ টাকার কাজ করলে দিন চইলা যাইতো। এখন ৮০০-১০০০ হাজার টাকার কাজ করলেও থাকে না।’

বর্তমানে ২১০ জন কুলি রয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন কমলাপুরে। এদের কেউ এসেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে, কেউ অভাবের তাড়নায়, আবার কেউ নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে, কেউ বাবা-মার সঙ্গে থেকে স্টেশনেই কুলির জীবন বেছে নিয়েছেন। কুলির নাম্বার দেন স্টেশন কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করেন না তারা। তাদের নিয়োগসহ সবকিছু দেখার দায়িত্ব থাকে কুলি সরদারের হাতে। তবে কুলি সরদার নির্বাচন করেন কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার।

এ বিষয়ে কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আফছার উদ্দিন বলেন, ‘সরদার নিয়োগ ছাড়া আমাদের সঙ্গে কুলিদের তেমন কাজ নেই। তবে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হলে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও তা মীমাংসা করার জন্য বলি।’

রেলের প্রায় সব কুলির জীবনই কাটে ট্রেনে যাতায়াত করা যাত্রীদের লাগেজ বহন করে। যখন হুইসেল বাজিয়ে স্টেশনে ট্রেন ঢুকে তখনই শুরু হয় তাদের আসল যুদ্ধ। গত শনিবার (১৩ নভেম্বর) সরেজমিনে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, প্ল্যাটফর্মে কেবল এসেছে এমন কোনো ট্রেন নেই। বসার স্থানে নিজেদের জীবিকা বহনকারী ট্রলি পাশে রেখেই ঘুমিয়ে আছেন ক্লান্ত কুলিরা। আবার কেউ কেউ হালকা শীতের রেশ দূর করছেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। কয়েকজন আবার কাজ শেষে ক্লান্তি দূর করতে মোবাইলে খেলা জমিয়েছেন।

jagonews24

এসময় কথা হয় ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক কুলির সঙ্গে। কথা শুরু করতেই প্ল্যাটফর্মে ঢুকে এগারো সিন্ধুর গোধূলি ট্রেন। কথা না বাড়িয়েই দ্রুত ট্রলি কাঁধে এগিয়ে যান তিনি। বৈচিত্র্যময় জগতে জীবনের তাগিদে এমন চিত্রই দিনভর চলে মার্কিন স্থপতি বব বুই-এর নান্দনিক শিল্পকর্মে তুলে ধরা দেশের এই বৃহৎ স্টেশনটিতে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও যাত্রীর আনাগোনা কম থাকায় কাজ পাচ্ছেন না দিনমজুর এসব কুলিরা। ফলে আগের তুলনায় এক ধরনের কষ্টেই চলছে তাদের জীবন।

ছেলেমেয়ের পড়ালেখাসহ পরিবার নিয়ে থাকা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে কুলিদের। কেউ কেউ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন পার করছেন এই প্লাটফর্মেই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি জানান, ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পড়ালেখা না করেই ১৯৯০ সালে রাগ করে ঢাকায় আসলাম। আগে স্টেশনে অনেক কাজ ছিল, এখন নেই। খরচ বাড়লেও বাড়েনি আয়।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ের পড়াশুনার জন্য প্রতি মাসে ১২০০ টাকা বেতন দিতে হয়। প্রাইভেট খরচ ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ এখন মাত্র ১২-১৫ হাজার টাকার কাজ করতে পারি। ৪০ হাজার টাকা ঋণ করেছি।’

কথা শেষ না হতেই প্ল্যাটফর্মে আরেকটি ট্রেন ঢুকে। বেশ কয়েকজন কুলি ট্রলি নিয়ে ট্রেনের দরজা ও জানালায় এগিয়ে যান। মালামাল টেনে দেবেন এমন কাউকেই পাচ্ছেন না। এসময় কাজের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে মো. খালেক বলেন, ‘কাজ খুঁজতাছি কিন্তু একটাও খুঁইজা পাচ্ছি না।’ এভাবেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।

jagonews24

আগে ঢাকায় রিকশা চালাতেন কুলি মো. সুমন। পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় এখানে কাজের ব্যবস্থা করেন। আগে ৭০০-৮০০ টাকার কাজ করতে পারলেও এখন ২০০-৩০০ টাকার কাজ করতেই কষ্ট হয় তার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকাল ৮টায় আসলাম, ১২টা পর্যন্ত এখনও কোনো কাজ পেলাম না। কোনো টাকা আয় করতে পারি নাই। অথচ নাস্তাসহ খরচ ঠিকই হইছে।’

পাশে থাকা আরেক কুলি বলেন, ‘যাত্রী আসলে যাত্রীদের মালামাল নিয়া যাই। যাত্রীরা খুশি হইয়া যা দেয় তাই নিই। কম হয়ে গেলে কিছু চাইয়া নিই।’

জীবিকার তাগিদে ১০ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় আসেন মোহাম্মদ আলী। ২৫ বছর ধরে স্টেশনে কুলির কাজ করা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগে আমার যেখানে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো, এখন ৩০০-৫০০ টাকাও আয় হয় না। সবকিছুর খরচ বাড়ায় এখন খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। আগে ১০০ টাকায় যা পেতাম এখন ৫০০ টাকায়ও পাই না। পরিবারকে নিয়ে আগেই ভালো ছিলাম।’

দিনাজপুরের মো. ইসমাঈল জানান, ৮-৯ বছর ধরে এখানে কাজ করি। গতকাল সন্ধ্যায় আসলাম, দুপুর ১টায় ৫০০ টাকাও হয়নি। তিন হাজার টাকা বাসা-ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। আমাদের এত টাকা বাসা-ভাড়া দিয়ে যদি না থাকা লাগতো তাহলে চাপটা কম হতো।

এছাড়া কুলির কাজ করতেও কেউ কেউ টাকা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি জানান, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এখানে কাজ পেয়েছে এমনও আছে। কিন্তু কেউ বলবে না। কারণ কিছু বললেই তার সমস্যা হবে। এখানে হয়ত কাজই করতে পারবে না।

jagonews24

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুলিদের সরদার মো. নুরু মিয়া বলেন, ‘স্টেশন কর্তৃপক্ষ সরদার নিয়োগ দেয়। বাকিদের আমরা নিয়োগ দিই। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো টাকার লেনদেন হয় না। কয়েকদিন কাজ করলে ভালো কি মন্দ এসব ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করি আমরা। তারপর তাকে একটা নাম্বার দেওয়া হয়।’

কাজের বাইরেও কুলিদের নানা সমস্যা রয়েছে। দিনমজুর এসব কুলিরা বলছেন, ‘এতগুলো মানুষ আমরা। কোনো থাকা- খাওয়া, গোসল, চিকিৎসা এসবের কোনো ব্যবস্থা নাই। এসব সমস্যা কেউ বলেও না। রেল থেকে কোনো সহায়তাও পাই না।’

এ বিষয়ে কুলি সরদার মো. নুরু মিয়া বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাদের দাবি করার সুযোগ নেই। কোনো সহযোগিতাও রেল থেকে পাই না। ৪২ বছর ধরে কাজ করছি এখানে। মেডিকেল সহায়তাসহ কোনো সহায়তা পাই না আমরা।’

পরে এ বিষয়ে জানতে কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আফছার উদ্দিনের অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

আরএসএম/এআরএ/জিকেএস