ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ছুটি ও ঝুঁকিভাতা চান রেলের গেটম্যানরা

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৮:৪৪ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০২১

টিনের ঝুপড়ি ঘরে ট্রেনের অপেক্ষায় গেটম্যান রণদীপ সরকার। সাইরেন বাজতেই সচকিত হয়ে উঠলেন। খালি চোখে ট্রেনের দেখা মেলে না। এক দৌড়ে রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ের সিগন্যাল গেটে গিয়ে যানবাহনের গতিরোধ করলেন রণদীপ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এফডিসি মোড়ের লেভেল ক্রসিংয়ে দুই বছর ধরে এভাবে কাজ করছেন তিনি।

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এই গেটম্যান জানান, প্রতিদিন ৯৫টা ট্রেন পার হয় এফডিসি মোড়ের লেভেল ক্রসিং দিয়ে। তিনি আট ঘণ্টার ডিউটির মধ্যে ৩৫-৪০টা ট্রেনের সিগন্যাল দেওয়ার কাজ করেন। অর্থাৎ তার দায়িত্ব পালনকালে গড়ে ১২-১৫ মিনিট পরপর ট্রেন যায় এই ক্রসিং দিয়ে। সে হিসাবে রণদীপের অবসরের ফুরসৎ নেই বললেই চলে।

jagonews24

এফডিসি মোড়ে লেভেল ক্রসিং চারটি, যেখানে তিন শিফটে কাজ করেন ১২ গেটম্যান। এর মধ্যে ছয়জন স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত, ছয়জন মাস্টাররোলে অর্থাৎ চুক্তিভিত্তিক। রণদীপের চাকরিও মাস্টাররোলে।

রেলের ইনফরমেশন বুকের তথ্যমতে, সারাদেশের রেল নেটওয়ার্কে লেভেল ক্রসিং দুই হাজার ৮৫৬টি। যার মধ্যে এক হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। এসবের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রেলের স্থায়ী রক্ষী বা গেটম্যান আছেন। ৮২০টিতে আছেন চুক্তিভিত্তিক গেটম্যান।

রেলের এই স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের অভিযোগ, দায়িত্বপালনে তারা একনিষ্ঠ হলেও পান না প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা। যে ছুটি থাকে, সেটাও তারা ভোগ করতে পারেন না। এমনকি করোনাকালে সরকারের প্রায় সব পেশার কর্মী ঝুঁকিভাতা পেলেও তারা এক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন।

এফডিসির রেলক্রসিংয়ে সবার বড় গেটম্যান শাহ আলী। ৩২ বছর ধরে কমলাপুর, পাকশীসহ গুরুত্বপূর্ণ জংশনে কাজ করেছেন। রেলের স্থায়ী এই কর্মচারী বলেন, রেলের গেটম্যানের কোনো ছুটি নেই। কাগজে-কলমে ছুটি আছে, কিন্তু আমরা ভোগ করতে পারি না। লোকবল সংকটের কারণে আসলে কাউকে ছুটি দেওয়া হয় না। আমি যদি ছুটিতে যাই তাহলে সিগন্যাল গেট কে দেবে? বছরে ১০ দিনও ছুটি কাটাতে পারিনি। চাকরি আইনে মেডিকেল ছুটি, উৎসব ছুটি, ঐচ্ছিক ছুটি আমাদের আছে। কিন্তু পাই না।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, চাকরিতে ঢুকে মন হয় জেলে ঢুকে গেছি। রাতে যখন ছুটি হয় তখন যেন আসলে জেল থেকে বের হই। করোনার সময় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও কোনো ঝুঁকিভাতা পাইনি, এমনকি দেওয়া হয়নি কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও।

jagonews24

আরেক গেটম্যান মশিউর বলেন, এখানে যারা কাজ করেন তারা কোনো ছুটি পান না। ছুটির জন্য ঊর্ধ্বতন অফিসারদের পেছনে ঘুরতে হয়। মাস্টাররোলে যারা আছেন তাদের ঠিক মতো বেতনও দেওয়া হয় না। বেতন হয় চার-পাঁচ মাস পর।

সুরক্ষাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম না পাওয়ার কথা তুলে ধরে মশিউর বলেন, সুরক্ষা সরঞ্জাম কী দেবে? তিন-চার বছর আগে সিগন্যাল ফ্ল্যাগ দিয়েছে, সেগুলোও ছিঁড়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাগ দেওয়ার খবর নেই। গেটম্যানদের টর্চলাইট দেওয়ার কথা ছিল, সেগুলোও দেওয়া হয়নি।

লেভেল ক্রসিংয়ের গেটম্যানদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ধীরে ধীরে জননির্ভরতা কমিয়ে রেলকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। লেভেল ক্রসিংগুলোতে ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে, তাতে দুর্ঘটনা কমবে।

রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন জটিলতার কারণে গেটম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ। গেটম্যানের সংখ্যা বাড়লে তাদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়বে।

যদিও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ১ হাজার ৩০০’র মতো গেটম্যান নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। গেটম্যান স্বল্পতা কেটে গেলে তাদের সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত হবে।

লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় দায়ী অসচেতনতা
এদিকে রেল সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৬৩৬ জনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং থাকলেও ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই। এসব ক্রসিংয়ের বেশিরভাগেই নেই গেটম্যান। লেভেল ক্রসিংয়ে সিগন্যাল না মানা, গেটম্যান সংকট ও অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে এভাবে প্রাণ ঝরছে।

jagonews24

কতিপয় লোকের বেপরোয়া চলন-বলন ও অসচেতনতার কারণও এমন দুর্ঘটনায় দায়ী বলছেন গেটম্যানরা।

গেটম্যান রণদীপ সরকার জাগো নিউজকে বলছিলেন, অনেক বড় নেতা আছেন। সিগন্যাল দেওয়ার পরও তা মানতে চান না। জোর করে সিগন্যালের বাঁশ উঠিয়ে মোটরসাইকেল পার করেন। তখন তাদের ছেড়ে দিতে হয়। মোটরসাইকেল চালকরা সিগন্যাল মানতে চান না।

আরেক গেটম্যান শাহ আলী বলেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে গেটম্যানদের দোষ দেওয়া হয়। আমরা নাকি ক্রসিংয়ে থাকি না। প্রতি ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর পর ট্রেন আসে যায়। আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার সময়ই নেই। আমরা আশপাশেই থাকি। অনেক সময় সিগন্যাল না মেনে পথচারী কিংবা যানবাহন চলে যেতে চায়। তখন আমরা তাদের আটকাতে চাই। বিশেষ করে প্রভাবশালীরা সিগন্যাল মানতে চান না। তারা ভয়ভীতি দেখান। সিগন্যাল গেট উঁচিয়ে ফেলেন বা ভেঙে ফেলেন। বাধা দিলে আমাদের গায়েও হাত তোলেন। আমাদের সঙ্গে হাতাহাতিও হয়।

লেভেল ক্রসিং পারাপারে সচেতনতা বাড়লেই দুর্ঘটনা বন্ধ হবে বলে মনে করেন রণদীপ-শাহ আলীর মতো গেটম্যানরা।

এসএম/এইচএ/জিকেএস