ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

এখনো সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ে

জেলা প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ০৬:০৪ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

সেই বন্ধুর কথা আজও মনে পড়ে। মনে হলেই আঁতকে উঠি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। আমৃত্যু পর্যন্ত হয়ত তাকে ভুলতে পারবো না। কথাগুলো বলতে বলতে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বড় মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন।

১৯৭১ সালে ইপিআর ক্যাম্প (বর্তমান নওগাঁ বিজিবি-৪৩ ক্যাম্প) ছিল পাঞ্জাবের দখলে। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে প্রায় ৪’শ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা মিলে তাদের উপর হামলা করা হয়। বন্ধু মকছেদ আলী (সম্ভাব্য নাম) ইপিআর ক্যাম্পের ছোট যমুনা নদী সাঁতরিয়ে পার হওয়ার সময় পাঞ্জাবরা তার মাথায় গুলি করে। এতে পানির মধ্যে তিনি তলিয়ে যায়। পাঞ্জাবরা চলে গেলে নদী থেকে বন্ধুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ইপিআর ক্যাম্পের বাঁশ ঝাড়ের পাশে তাকে কবর দেয়া হয়। বন্ধু মকছেদ আলীকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলার কথা আজও তিনি ভুলতে পারেননি।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অবহেলায় আছেন। কিছু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া অনেক মুক্তিযোদ্ধা সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই সমাজে অনেক বড় অবস্থানে আছেন এবং সন্তানরাও বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছেন।

Naoga

এমনি একজন সফল এবং স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেন। ১৯৫৬ সালে ১৬ এপ্রিল নওগাঁ সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের চক-কালিদাস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৃত. বছির উদ্দিন সরদার এবং মাতা বুলিআরা বেগম। পাঁচ ভাই-বোনের (তিন ভাই ও দুই বোন) মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। সংসার জীবন ছিল খুব কষ্টের। তেমন পড়াশুনা করতে পারেননি। তবে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। চার মাস হলো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।

প্রায় ১৪ বছর থেকে নওগাঁ শহরের আনন্দ নগর মহল্লায় সাড়ে ৪ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করে মা বুলিআরা বেগম ও স্ত্রী মিনাআরা পারভীনকে নিয়ে বসবাস করছেন। চার মেয়ের সবাই চাকরি করেন। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ভাল পরিবার দেখে।

১৯৭১ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। ১৬ বছর বয়সে দেশের টানে, জাতির টানে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় এসএসসি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। দুই দুই বার যুদ্ধে গিয়েও ফিরে এসেছেন। বাবা-মা জোর করে ধরে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তৃতীয়বার কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি বাড়ি থেকে চলে যান।

তিনি ভারতের মধুপুর ক্যাম্পে প্রথম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখানে সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা আফজাল হোসেন এবং জাফর হোসেন কমান্ডার ছিলেন। এরপর পতিরামপুর প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ভারতের সেনাবাহিনীদের মাধ্যমে শিলিগুড়িতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রায় ১০/১২ দিন এলএমজি, রাইফেল, অ্যাসেলর, গ্রেনেডের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের কুরমাইল কামারপাড়া আনছার ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে কাজ করেন। বিভিন্ন স্থানে তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।

অবশেষে ১৯৭১ সালে অস্ত্রপাতি নিয়ে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে বাংলাদেশে চলে আসেন। ৩-ব্যাটালিয়নে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন প্রায় ৭০/৭৫ জন। কমান্ডার ছিলেন লফির উদ্দিন যিনি মারা গেছেন। প্রথম যুদ্ধ সম্ভবত ৫/৬ ডিসেম্বর জয়পুরহাট শুটিবাড়ি ব্রিজের কাছে। রাজাকার বাহিনীরা শুটিবাড়ী নদীর পূর্ব পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং নিয়মিত তাদের টহল দেখা যেত। শুটিবাড়িতে মঙ্গলবাড়ী হাট দখল করার কথাশুনে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। বিকেল ৫টা থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। সারারাত থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। এভাবে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়।

Naoga

সেই যুদ্ধে পাকসেনার সংখ্যা ছিল প্রায় ৪’শ জনের মতো। যুদ্ধে পাকবাহিনীর কিছু নিহত হয় এবং কিছু বাঙালি আহত হয়। অবশেষে তারা পরাজয় মেনে নিয়ে সেখান থেকে বিদায় হয়। বেলালবিলেন, তাদের আক্রমণ করলে তারা আর সামনে এগোতে পারেনি। তারা যদি সেদিন সামনের দিকে এগিয়ে আসতো তাহলে হয়তো আমরা কেউই বেঁচে থাকতে পারতাম না।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। সংসারের অভাব অনটন থাকায় তিনি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন নি। সংসারের কাজে মনোনিবেশ করেন এবং পরিবারের কথায় তিনি ১৯৭৬ সালে বিয়ে করেন। ১৯৮৩ সালে সোনালী ব্যাংকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে তিনি সেখানে দরখাস্ত করেন। চাকরি হয়ে গেলে প্রথমে যোগদান করেন সোনালী ব্যাংক নওগাঁ প্রধান শাখায়। দীর্ঘ ৩২ বছর চাকরি করার পর অবসরে আসেন ২০১৫ সালে ১৫ এপ্রিল। তিনি ২০০০ সালের ১ জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান।

মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেন বলেন, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। দেশে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার মূল্যায়ন করতে পারেনি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা রিকশা, ভ্যান চালিয়ে কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন পার করছেন।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হলেও যে স্বাধীনতা প্রয়োজন তিনি তা এখনো পাননি। কারণ কিছু রাজাকার আলবদ এখনো বিভিন্নভাবে কটূক্তি ও কটু কথা বলেন। কথাগুলো শুনে মনে কষ্ট পান। ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করছেন কতিপয় ব্যক্তিরা। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।

আব্বাস আলী/এসএস/এমএস