ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

মুক্তিযুদ্ধ : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অনিবার্যতা

প্রকাশিত: ০৭:০৬ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৭১ সালে ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা লাভে মৌলিক কতোগুলো পার্থক্য রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা এদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই থাকা প্রয়োজন। তবে পার্থক্যগুলো সম্পর্কে যতোবেশি গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা থাকবে ততোবেশি আমরা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারবো। তরুণ প্রজন্ম এ সব ধারণা যতোবেশি ধারণ করবে ততোবেশি মুক্তিযুদ্ধের সমগ্রতাকে যথাযথভাবে বুঝতে সক্ষম হবে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল শক্তিশালী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দখলদারিত্ব থেকে। যেমন, স্পেনের ঔপনিবেশিকতা থেকে লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছিল। আফ্রিকার বেশির ভাগ জাতি ও রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছিল ফরাসি ঔপনিবেশ ছিন্ন করে, বেশ কিছু অঞ্চলে ছিল ব্রিটিশ ও পর্তুগিজ ঔপনিবেশ।

এশিয়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশ ছিল সবচাইতে বেশি। সুতরাং, ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশ ব্যবস্থা ছিন্ন করে। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভও হয়েছিল ব্রিটিশ কলোনিকে পরাস্ত করেই। সে কারণে ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে ঊনিশ এবং বিশ শতকে পৃথিবীব্যাপী যে সব স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল সেগুলোর শাসন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে, আবার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের একান্ত কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এগুলোর সামগ্রিক গুরুত্বের পাশাপাশি আলাদা ধরনগুলোও বিশেষভাবে স্মরণ-রাখতে হবে। যেমন, পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন, পর্তুপাল, ইতালি নিজ নিজ কলোনিতে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। এসব শাসন কতোগুলো প্রশাসন, বিচার, রাজস্ব, শিক্ষা-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে যার যার কলোনিতে স্থাপন-প্রতিস্থাপন করেছে। এতে ঔপনিবেশগুলো হাজার বছরের, প্রথাগত শাসন, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ধারা বা ব্যবস্থা থেকে অনেকটাই বের হয়ে গেছে।

এখানে প্রথাগত সমাজপদ্ধতি এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও কোথাও দ্রুত সমন্বয় হয়েছে, কোথাও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে, কোথাও বিলম্ব হয়েছে। তবে মিশ্রণের সমাহার কমবেশি সর্বত্রই ঘটেছে। ইউরোপের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রভাব সুদূর লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, গোটা এশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চল ঔপনিবেশিক শাসনে দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে, কোনো কোনো অঞ্চল গোত্রীয় প্রথার পরিবর্তন ঘটাতে খুব বেশি দূরে অগ্রসর হতে পারে নি। এর অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। বড় মাপে যে কারণটি স্মরণ রাখা যেতে পারে তা হচ্ছে, ঔপনিবেশিক শাসনের বয়স, ধরন, চরিত্র লক্ষ্যাভিযান বা লক্ষ্যাভিমুখিনতা এক রকম ছিল না। আবার সব অঞ্চলের বাস্তবতাও এক রকম বা কাছাকাছি ছিল না। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব দুনিয়াব্যাপী সর্বত্র অভিন্নভাবে পড়তে পারে নি। তবে সামগ্রিক অর্থেই ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা শোষণ-শাসনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর প্রভাভ বিস্তারের প্রতিক্রিয়া কমবেশি পুরাতন ব্যবস্থাকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থামুখিন চিন্তা-ভাবনার উজ্জীবন ঘটিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে সরাসরি মুক্ত হয় নি। ১৯০৫ সালের আগে সে ধরনের সম্ভাবনা এবং সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাংলার সমাজ জীবনে যে বিভাজনের ধারণার বীজ রোপন করেছিল তার ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন রাজনীতির মূলধারা থেকে ক্রমেই দূরে সরে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিভাজিত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের ধারায় ধাবিত হতে থাকে। সেখান থেকেই কৃত্রিম দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবন, দ্বিজাতি তত্ত্বের বাস্তবতা-অবাস্তবতা যাচাই-বাছাই করার মতো রাজনৈতিক ও সামাজিক বোধ এ সমাজে তৈরি না হওয়ায় গোটা সমাজই দ্বিজাতিতত্ত্বে বুদ হয়ে গেল, এক ধর্ম-সম্প্রদায় অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের রক্তে স্নান করতে দ্বিধা করে নি। হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই উপেক্ষিত হয়ে গেল, জন্ম নিল কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠনের ভাবাবেগ। পাকিস্তান সেই ভাবাবেগের ফসল কৃত্রিম এক রাষ্ট্র-যার কোনো ইতিহাস-সংলগ্নতা ছিল না, বরং অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়ে পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

অথচ ভৌগোলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন রাষ্ট্র কখনও কলোনিয়াল চরিত্রের হতে পারে না। কেননা, আর্থ-সামাজিক, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক কোনো বন্ধনই আধুনিক কোনো রাষ্ট্রে এমনভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। ১২শ মাইলের পূর্ব-পশ্চিমের ব্যবধান শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যগতভাবেও যোজন যোজন দূরত্বের। এ ধরনের রাষ্ট্র বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে যারা কল্পনা করতে পেরেছিলে তাদের রাষ্ট্র-রাজনীতির ধারণা এবং জ্ঞান নিয়ে লজ্জিত হতে হয় আমাদেরকে। কিন্তু ১৯৪০-১৯৪৬-পরবর্তী সময়ে এমন একটি সাঁকোবিহীন রাষ্ট্র তৈরির উন্মাদনায় আমরাই মেতে উঠেছিলাম, এর ফলেই জন্ম নিল পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র-যার ন্যূনতম কোনো অতীত ছিল না, ইতিহাস-ঐতিহ্যও ছিল না। এমন ইতিহাসবিযুক্ত রাষ্ট্র কোনোভাবেই আধুনিক চরিত্র ধারণ করতে পারে না, এমনকি মধ্যযুগের রাজতান্ত্রিক চরিত্রও পেতে পারে না। কেননা, এগুলোর কোনো আর্থ-সামাজিক ভিত্তি এ অঞ্চল বা পশ্চিম অঞ্চলে ছিল না। এসব রাষ্ট্র-রাজনৈতিক অপরিহার্য উপাদানের কথা অনেকেই-ভাবতে চায় নি। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রটি পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি কেমন আচরণ করবে, উভয় অঞ্চলের মধ্যে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি কী হবে তা-ই নির্ধারণ করতে পারে নি।

অন্য দিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের অবস্থানও সমাদৃত ছিল না। এটি অনেকটাই ঔপনিবেশিক আচরণ। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে কলোনিয়াল চরিত্র অর্জন করাও সম্ভব ছিল না। কলোনিয়াল রাষ্ট্র হচ্ছে প্রাক-আধুনিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্র চরিত্রের। ইতিহাসের ধারাবাহিকতাতেই কেবল এমন রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে তা আশা করাই বৃথা। তবে দুনিয়ার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার খারাপ উদাহরণগুলো এমন রাষ্ট্রের গ্রহণে কার্পণ্য প্রদর্শনের আগ্রহ বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই- তাছাড়া ঘটেছেও তাই। পাকিস্তান শুরুতেই পূর্ব বাংলার প্রতি ঔপনিবেশিকতার খারাপ প্রবৃত্তিগুলো প্রয়োগ শুরু করে। খারাপ নজির স্থাপনের কারণ হচ্ছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে সব শক্তির উত্থান ঘটেছিল সেগুলোর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিল সামন্ততান্ত্রিক আমলা-সামরিক এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন। এসব শক্তির হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পড়লে রাষ্ট্রটি কলোনিয়ান চরিত্র ধারণ করারও সুযোগ পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না।

পাকিস্তান ১৯৪৭ সাল থেকে যতো সম্মুখে হেঁটেছে ততবেশি সামরিক-সাম্প্রদায়িক জান্তা-নির্ভর হয়ে উঠেছে। এসব সামরিক-আমলানির্ভর জান্তাদের সামাজিক ভিত্তি হচ্ছে পাকিস্তানের প্রথাগত সামন্ত ব্যবস্থা-নির্ভর, সাংস্কৃতিকভাবে গোত্রীয় প্রধানকেন্দ্রিক, ধর্ম- সাম্প্রদায়িক, একই সঙ্গে ভোগ-বিলাসনির্ভর। এ ধরনের পাশ্চাৎপদ বহু গাঠনিক অবস্থান থেকে আসা বহুমাত্রিক সুবিধাবাদী শক্তির হাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতৃত্ব কুক্ষিগত হতে থাকে। এরা ক্রমেই সামরিক শক্তির ওপর বেশি বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। পাকিস্তান দ্রুতই একটি সামরিক-জান্তা শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হতে থাকে। যতো এটি জান্তা-নির্ভর হতে থাকে ততো বেশি স্বৈর অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার সঙ্গে সেই ক্ষেত্রে মানসিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক- সকল ক্ষেত্রেই ঐক্য গঠনের চাইতে দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২৩ বছরে সেই দূরত্ব ১২শ মাইল থেকে ১২ হাজার মাইলেরও বেশি ছাড়িয়ে যেতে থাকে। যত বেশি এই দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে ততবেশি সামরিক জান্তানির্ভর শাসক গোষ্ঠী বর্বর মানসিকতায় এই দূরত্বকে বাড়িয়ে দেয়ার শক্তি প্রয়োগ ঘটায়। কোনো আধুনিক কলোনিয়াল রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী কোনো সংঘাতে জড়ায় নি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু কোনো সংঘাত শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে দেয় নি ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি। ততদূর পর্যন্ত জড়ানোর আগেই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার দৃষ্টান্ত রেখেছে। ফরাসিদের সঙ্গে কলোনির কোথাও কোথাও সংঘাত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১-এর মতো লাখ লাখ মানুষ মেরে, নারী ধর্ষণ করে, বাড়িঘর পুড়িয়ে, কোটি মানুষকে শরণার্থী বানিয়ে ‘মাটি আঁকড়ে থাকার মানসিকতা বর্তমানকালে কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি প্রদর্শন করে নি। পাকিস্তান যা করেছে তা ঔপনিবেশিক শক্তির চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর, অমানবিক, বর্ণবাদী-সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিনাৎসি চরিত্র-নির্ভর।

পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির এমন আচরণ পাকিস্তান ভূখণ্ডের বৃহত্তর জনগণের মধ্যেও ব্যাপকভাবে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার শিক্ষা ব্যবস্থা, অপপ্রচারনির্ভর রাজনীতি, সংস্কৃতিবিরোধী ভেদবুদ্ধি এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে এতোটাই পেছনে ঠেলে দিয়েছিল যে, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত তার সাধারণ মানুষের জন্যে একটি স্বাভাবিক জীবন যাপনের রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণের রায়কে অবজ্ঞা করা হলো, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করা হলো, অবশেষে ১৯৭১ এর ২৫-মার্চ রাতে বর্বর বাহিনী পূর্ববাংলার জনগণের ওপর সশস্ত্র সামরিক জান্তার পৈশাচিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলার জনগণকে নাগরিক, মানবিক, মুসলমানিত্ব-এর কোনো দৃষ্টিতেই যে দেখতো না- তাই তাদের আকস্মিক আক্রমণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। কোনো আধুনিক রাষ্ট্র তার অপর অঞ্চলের নিরীহ নাগরিকের ওপর  যখন এভাবে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে তখন বুঝতেই হবে এটি কোনো সভ্য রাষ্ট্র নয়। ঔপনিবেশিক শাসকরাও তাদের কলোনিতে এভাবে কোথাও এতোবড় গণহত্যা সংঘটিত করে নি। পাকিস্তান নিজেই প্রমাণ করেছে যে, তারা পূর্ববাংলার জনগণকে নয়, এ অঞ্চলের মাটি ও সম্পদ দখলে রাখতে নয় মাস গণহত্যা চালিয়েছিল। বিষয়টি জনগণ ১৯৬৯ সাল থেকে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, ১৯৭০ এর নির্বাচনোত্তর অভিজ্ঞতায় আরো বেশি বিশ্বাসভঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হয়, পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস বেশিরভাগ মানুষের এই সময়ে ভেঙ্গে যায়।

১৯৭১- এর মার্চ মাসের শুরু থেকে মানুষ এক দফা তথা স্বাধীনতার কোনো বিকল্প দেখছিল না। জনগণের মধ্য থেকে স্বাধীনতার আকাক্ষা এবং দাবি দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব- যাকে মানুষ ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে অবিসংবাদিত নেতা রূপে নির্বাচিত করেছে, এই সময়ে তার কাছে স্বাধীনতার পথে নিজেদের জীবন উৎসর্গের প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করে ফেলে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার প্রাথমিক ঘোষণা দিয়ে করণীয় নির্ধারণ করে দেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চাইতেও অনেক বেশি কঠিন, জটিল এবং জীবন উৎসর্গের প্রয়োজন হয়ে পড়বে- সেটি তিনি বুঝিয়ে দিলেন। ২৫-মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ পরিকল্পনা মোতাবেক অতর্কিত নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়, সেটি শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে- এমনটি পাক সরকার কল্পনাও করতে পারে নি। জনগণের মধ্য থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ জেগে ওঠে, একটি বৈধ সরকারের নেতৃত্বে সকলে প্রাণপণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, আন্তর্জাতিক বৈরি পরিবেশকে অতিক্রম করে নেয়, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার মানুষের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করে, সম্মিলিতভাবে যুদ্ধজয়ে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জান্তা বাহিনী আত্মসমর্পন করে, বাংলা ও বাংলার জনগণের বিজয় অর্জিত হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে ভেসে ওঠে লাল সবুজের একটি নতুন পতাকা। নতুন জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বাস্তবে আবির্ভূত হলো। এ হচ্ছে ইতিহাসের পরম সত্য, অনিবার্য পরিণতি।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/বিএ