ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সিলেট মুক্ত হয় এই দিনে

প্রকাশিত: ০৬:৫২ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

আজ ১৫ ডিসেম্বর, সিলেট মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে মুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর জন্মভূমি সিলেট। দেশ স্বাধীন হওয়ার একদিন আগে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সেদিন মুখর ছিলো সিলেট শহর। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সী মানুষ ছিলো আনন্দে উদ্বেল। সব স্লোগান, সব কণ্ঠস্বর এক স্রোতে মিশে গিয়েছিল সেদিন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের দুঃস্বপ্নের সেই রাত সিলেটকেও তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিল। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সারা দেশের মতো সিলেটও ছিলো ঐক্যবদ্ধ, অবিচল। পাকিস্তানি দোসররা বাঙালি জাতির উপর বর্বর শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই রুখে দাঁড়িয়েছিল সিলেটের মানুষ। একটি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল মুক্তিকামী মানুষ। দৃশ্যপটের এই শহরে সেদিন বইছিল ভিন্ন বাস্তবতা। চারদিকে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল আলী আমজাদের ঘড়ি। কিনব্রিজ হয়েছিল দ্বিখণ্ডিত। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন নির্মাণ, আবাস ভূমি।

৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর ভারতীয় বোমারু বিমান সিলেট শহরে প্রচণ্ড হামলা চালায়। এই হামলা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাদিমনগর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। একই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দক্ষিণ জালালপুর ও পশ্চিম লামাকাজিতে আসে। তখন ফাঁকা ছিলো শুধু উত্তর দিক।

কিন্তু সেদিকে সীমান্তবর্তী পাহাড়, বনাঞ্চল থাকায় দোসরদের পালাবার কোনো পথ ছিলো না। হঠাৎ একদিন নাম না জানা দু’জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা খাদিমনগর থেকে একটি গাড়িতে চড়ে পাকিস্তানি দোসরদের আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা শহরে মাইকিং করতে থাকেন। তাদের সেই মাইকিংয়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন করে সাহসের সঞ্চার হয়। তখন সিলেট শহর ছিলো পুরোদমে উত্তপ্ত।

এদিকে, মাইকিং করতে করতে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা দু’জন ক্রমান্বয়ে শহরের দিকে আসেন। পথে পথে, বাসা-বাড়ি, দোকানপাটে থাকা উদ্বিগ্ন মানুষ তাদের কণ্ঠের ধ্বনি শুনে আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন। বাহ, বাহ দিচ্ছিলেন সবাই। যে গাড়িতে মাইকিং চলছিল সেই গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে করে শহরের দিকে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উত্তর অঞ্চলের এক বেসামরিক উপদেষ্টা, তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক কর্ণেল বাগচী। শহরের লোকজন অত্যন্ত আহ নিয়ে তাদের যাত্রা দেখছিলেন।

তখন হানাদারদের অবস্থান ছিলো সিলেট সরকারি কলেজের আশপাশে। তারাও শক্ত অবস্থানের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। ক্রমান্বয়ে (গোপনে) তারা সংগঠিত হওয়ার জন্য শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মাইকিং করার পর শত্রুরা আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদিমনগরের দিকে ফিরে যেতে হয়। ওই দিন কদমতলী এলাকায় ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ইটখোলায় থেকে যাওয়া ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ৩৫ জনের মিত্র বাহিনীর একটি দল। ওই দলের সঙ্গে সেদিন আরও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক, গামা, আফরাইন, আব্দুল মতিন, ম.আ. মুক্তাদির, মনির উদ্দিন, ইশতিয়াক আহমদ, বেলায়েত হোসেন, বেলায়েত হোসেন খান, জামানসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ওইদিন মোকাবেলা করেছিলেন শত্রুদের।

সেদিনের অপারেশনে নেতৃত্ব দেন রানা নামে এক ভারতীয় সুবেদার। প্রায় ৯ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পনের পথ বেছে নেয়। এরপর শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়। মাছিমপুর থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শক্তিশালী মর্টার এস আঘাত করে সুবেদার রানাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিহত হন। আহত হন মিত্র বাহিনীর আরও দুই সদস্য। তবে তাদের নাম সেদিন জানা ছিলো না কারো।

পরে ১৪ ডিসেম্বর সরকারি কলেজের আশপাশ থেকে শত্রুরা তাদের অবস্থান তুলে নেয়। ওইদিন দুপুরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও কর্নেল বাগচী বিনা প্রতিরোধে শুধু শহরেই নন, বিমানবন্দরের পাশে গড়ে ওঠা শত্রুদের মূলঘাঁটির কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুরে আসেন।

ইতোমধ্যে ‘জেড’ ফোর্স’র সেনারা এমসি কলেজ সংলগ্ন আলুতলে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সবদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ওইদিন সন্ধ্যায় চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর জওয়ানরা দলবদ্ধভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে সিলেট শহর।

পাড়া-মহল্লা, অলিগলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে তাদের পদধ্বনিতে। জয় বাংলা জয় বাংলা স্লোগানে সরে যায় রাজাকার আলবদরদের পায়ের তলার মাটি। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা রাতেই গা ঢাকা দিতে শুরু করে।

পরদিন ১৫ ডিসেম্বর সকালে সকল বয়সী মুক্তিপাগল মানুষের ঢল নামে শহরে। তাদেরকে ঘিরে ভিড় জমে পথে পথে। ঘড়িতে তখনো ১২টা হয়নি। শহরবাসী মাইকের মাধ্যমে গোটা সিলেটে প্রচার করতে থাকেন ‘সিলেট হানাদার মুক্ত’ সিলেট হানাদার মুক্ত’। সেই থেকে সিলেট মুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে।

ছামির মাহমুদ/বিএ