রাজাকার পুত্রের দখলে বুদ্ধিজীবী ড. জিসি দেবের পৈতৃকভিটা
বিশ্ববরেণ্য মানবতাবাদী দার্শনিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জিসি দেব) পৈতৃকভিটা স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও রাজাকার পুত্রের হাত থেকে দখলমুক্ত হয়নি। এতে করে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ড. জিসি দেবকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৮ (মরণোত্তর) পদকে ভূষিত করে জাতি আংশিক দায়মুক্ত হলেও সিলেটের বিয়ানীবাজারস্থ পৈতৃকভিটাটি এখনো দখলমুক্ত করা হয়নি।
ড. জিসি দেব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি বিয়ানীবাজারবাসীকে যতটা গর্বিত করেছে ততটা হতাশ করেছে তার পৈতৃক বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়ায়। সচেতন নাগরিক সমাজের দাবি অবিলম্বে বাড়িটি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেব জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস এলে বাড়িটি উদ্ধারের দাবি উঠলেও পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়ে সকল কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলার ১১নং লাউতা ইউনিয়নের লাউতা গ্রামে ড. জিসি দেবের পৈতিক বাড়ির সিংহভাগ অবৈধ দখলদারদের দখলে। দখলদাররা সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় স্থানীয় বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা রইজ্জুদ আলী ওরফে রইয়া রাজাকার প্রথমে বাড়ির কিছু অংশ দখল করে পরবর্তীতে বাড়ির অন্যান্য অংশও ধীরে ধীরে বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে রইয়া রাজাকারের ছেলে সমিক উদ্দিন দখলকৃত অংশে পাকা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। অন্য অংশে ফনওই মালাকার ও গৌরাঙ্গ চন্দ্র ঘর নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন।
বাড়িটি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেবের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে জাদুঘর অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আলোর মুখ দেখবে এমনই আশা বাড়ি উদ্ধার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সুশীল সমাজের।
বাড়িটির ভূমির মোট পরিমাণ ২.৪৭ শতক। চলমান জরিপে ১.৪৭ শতক স্থানীয় জিসি দেব স্মৃতি সংসদের নামে রেকর্ড করা হয়েছে এবং ভূমির এক একর ভিপি খতিয়ানভুক্ত রয়েছে।
অভিভাবকহীন হিসাবে পড়ে থাকার কারণে এটি ভূমিদস্যু মহল কাগজে কলমে লিজ দেখিয়ে ঘর নির্মাণ করে চিরতরে দখলের পায়তারা করে চলেছেন সমিক উদ্দিন। দখলকারী পরিবারের অভিভাবক একজন স্বাধীনতা বিরোধী হওয়ার পর কিভাবে এই অনুমতি পায় তা এলাকাবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও সেই ড. জিসি দেবের সম্পত্তি দখলমুক্ত না হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা কৌতূহল। বাড়িটি উদ্ধার করতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন চলে আসলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন।
কেবল তাই নয় সাত কাঠা জমির ওপর ঢাকায়ও ড. জিসি দেবের আরেকটি বাড়ি রয়েছে যা বর্তমানে বেদখলে। ড. জিসি দেব বাড়িটি হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে লোন নিয়ে কিনেছিলেন। বাড়ির অর্ধেক অংশ পালিত ছেলে ও মেয়ের নামে এবং অর্ধেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করে যান। বাড়িটি দখলমুক্ত করতে আদালতে মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ড. জিসি দেবের সম্পত্তি দখল প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি ফজলুল হক বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ড. জিসি দেবের বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়া মানে সমগ্র দেশ এবং জাতির ব্যর্থতা।
স্বাধীনতা পদক সম্মাননা আরো অনেক আগে দেয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করে কবি ফজলুল হক বলেন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় অতএব এখনই দলখলমুক্ত করার উপযুক্ত সময়। কেবল পদক দেয়ার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র দায়মুক্ত হলে চলবেনা তার সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে হবে।
ড. জিসি দেব স্মৃতি পরিষদ বিয়ানীবাজারের আহ্বায়ক ও সিলেট মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার জাগো নিউজকে বলেন বলেন, প্রায় ৫/৬ বছর পূর্বে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় জিসি দেবের বাড়ির একটি অংশ আমরা উদ্ধার করে ছিলাম। তবে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কিছু জায়গা বেদখল রয়ে গেছে।
লাউতা ইউনিয়নে ড. জিসি দেব স্মৃতি সংসদের সভাপতি লাউতা ইউপি চেয়ারম্যান এমএ জলিল বলেন, ড. দেব আমাদের অহংকার, আমরা আশা করি অবিলম্বে তার বাড়িটি দখলমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
প্রসঙ্গত, পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজারের কৃতি সন্তান আধুনিক মানবতাবাদী দর্শনের পথিকৃৎ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ড. জিসি দেব) ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
গ্রামের বালক বিদ্যালয় দিয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তারপর মধ্য স্কুল যা পরবর্তী লাউতা উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। অতঃপর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ও অঙ্কে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে (বর্তমানে স্যার সুরেন্দনাথ কলেজ) দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন।
১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান দেন এবং মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত দর্শন বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে জগন্নাথ হলের প্রভোস্টও ছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন।
দর্শনের পথিকৃৎ ড. দেবের মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডে উৎফুল্ল হয়ে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা হয় দি গোবিন্দ সেবা ফাউন্ডেশন ওয়াল্ড ফর ব্রাদার হুড। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের দেব সেন্টার ফর ফিলসফিক্যাল স্ট্যাডিজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ছামির মাহমুদ/এআরএ/আরআইপি