ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬৬ বার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেই

জেলা প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

গোলাম মোস্তফা ভূঁঞা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজসেবক। তিনি ১৯৫১ সালের নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের ঘোষকামতা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবা মরহুম মৌলভী মোকসেদুর রহমান ভূঁঞা ও মাতা মরহুম আনঞ্জুমের নেছা। তিনি বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।

১৯৬৯ সালে অধ্যাপক মো. হানিফ, মোস্তাফিজুর রহমান, গোলাম সারোয়ার পাটোয়ারী ও মোস্তাফিজুর রহমান লুতুর অনুপ্রেরণায় গণঅভ্যুথানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন।

তিনি ১৯৭০ সালে বেগমগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহম্মেদ সুলতান (বজরা) বি.এল.এফ (মুজিব বাহিনীর) বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নিপূণ তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি, উপ-প্রধান আ .স.ম আবদুর রব, জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ও রাজনৈতিক সমন্বয়কারী, মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৬৬ বার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া ও ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা এবং দেশের ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, চিকিৎসা সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করাই ছিল তার অন্যতম দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে তিনি জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং বিভিন্ন সময়ে জেলা-উপজেলা ও জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণ করেন।

রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তিনি একজন সফল সংগঠক হিসেবে সকলের সুপরিচিত। তিনি সোনাইমুড়ী অন্ধ কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠতা সাধারণ সম্পাদক, নাটেশ্বর ইউনিয়ন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি ছনুয়া নাজমুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, সদস্য জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সদস্য সার্বজনীন জন্ম নিবন্ধন টাস্কফোর্স কমিটি, সদস্য উপজেলা স্কাউট, সদস্য জেলা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন, সদস্য খাস জমি বিতরণ কমিটি, উপদেষ্টা দি গ্রিন লাইফ, সদস্য বজরা শাহী জামে মসজিদসহ বর্তমানে তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে দেশ প্রেমিক ও মানব হিতৈষী গোলাম মোস্তফা ভূঁঞা সাত সন্তানের জনক।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জাগো নিউজকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত দিনগুলোর উত্তাল তরঙ্গ আজো হৃদয়ে আছড়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই মেশিনগানের শব্দ, মর্টারের আওয়াজ, জয় বাঙলার প্রতিধ্বনি। আমরা চারজন। আমি, মরহুম আবদুল হালিম (হাটির পাড়/ছাচুয়া গ্রাম) ও মোজাম্মেল হোসেন বাচ্চু (কেশারপাড়)। যুদ্ধকালীন অবস্থার নিপুণ তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করা এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য বৃহত্তর নোয়াখালীর ছাত্র যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা ও দেশের ভেতরে তাদের থাকা খাওয়া প্রভৃতির দায়িত্ব পালন করেন।  

মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি, উপ-প্রধান আ স ম আবদুর রব, জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ও রাজনৈতিক সমন্বয়কারী মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ও তার সঙ্গীরা ৬৬ বার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেন।

Fight

যুদ্ধকালীন সময়ে অনেকে ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা আজও তার মনে দাগ কাটে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা ঘটনাটি তিনি এখনো ভুলতে পারেননি। একান্ত আলপচারিতায় সে স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, মধ্য আগষ্ট ‘৭১ মেঘলা আকাশ। সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।

কলেজটিলা, আগরতলা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা গুণবতি রেল স্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে রেল লাইন পার হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। বেলা গড়িয়ে তখন সময় বিকেল চারটা কি পাঁচটা। একটু দূরেই গুনবতি রেল স্টেশন গোডাউনে পাক আর্মি ও মিলিয়িশায়া ক্যাম্প। হঠাৎ আমাদের কানে আওয়াজ ভেসে আসল দুশমন যাতাহায়, দুশমন যাতাহায়। আমরা তখন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়ি। বিধিবাম! পাঞ্জাবি আর মিলিশিয়াদের হাত থেকে রেহাই পেলেও রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজন আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ধরে ফেলে এবং একটি গোয়াল ঘরে বেঁধে আমাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুণছি।

মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছি। সৌভাগ্য যে, আমাদের বন্দি করার সংবাদটি নিকটস্থ পাকসেনা ক্যাম্পে কেউ পৌঁছায়নি এবং আমাদের শরীরও কেউ তল্লাশি করেনি। এসময় আমাদের সহযোদ্ধা, অসীম সাহসী ও বীরত্বের অধিকারী মরহুম আহমেদ সুলতান তার শরীরে লুকায়িত রিভলবার ব্যবহার করে মুক্তি পাওয়ার জন্য বার বার উদ্যত হচ্ছিলেন। তখন আমি বোবার ভাষায় তাকে সংযত করি। এসময় আমরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। নিশ্চিত মৃত্যু আমাদের শিয়রে। শত শত লোক আমাদের দেখতে সমবেত হয়েছে। উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ, চোখে মুখে বিষন্নতা। আমরা বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করছি এবং ভয়ে কাঁপছি। এরই মাঝে হঠাৎ একটা নাম শুনতে পাই `লিডার কুতুব ভাই` আসুক।

কে এ কুতুব ভাই? এ কুতুব উদ্দিন হলো ফেনী লাকসাম এলাকার রাজাকার কমান্ডার। তিনি ছদ্মবেশে রাজাকার কমান্ডার হয়ে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করতেন। মূলত, তিনি ছিলেন মরহুম খাজা আহম্মদ ও মরহুম শেখ ফজলুল হক মনির অনুগত লোক। ইতোমধ্যেই কুতুব উদ্দিন আমাদের আটক স্থানে পৌঁছে এবং হালকা নির্যাতন ও গালমন্দের কৌশলী ভূমিকা নিয়ে আমাদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। ছাড়া পেয়ে আমরা গভীর রাতে কানকিরহাটের দক্ষিণ হাটিরপাড়ে (ছাচুয়া গ্রাম) প্রাক্তন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রাণ পুরুষ মরহুম ডা. নুরুজ্জামান চৌধুরী সাহেবের বাড়ি পৌঁছাই। তিনি আমাদেরকে পরম যত্ন সহকারে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। সুস্থ হয়ে আমরা মাতৃভূমি শক্রমুক্ত করার জন্য আবার মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এসে তিনি জানান, অনেকে স্মৃতি এখন বিস্মৃতি হয়ে গেছে। এরই মধ্যে রণাঙ্গনের অনেক সাথীকে হারিয়েছেন। তাদের কথা এখনো মনে ভেসে উঠলে নিজের অজান্তে চোখের কোণায় পানি এসে যায়। এখনো যারা জীবিত আছেন আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে তারা ও চলে যাবেন না ফেরার দেশে। মুক্তিযুদ্ধের যে অর্জন তা সংরক্ষণ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হলে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কোনো কিছু অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয়ে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে আরও জানান, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যে কম তা বলা যাবে না। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিলো আরও বেশি। শোষণহীন সমাজ, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত দেশ, সমধিকারসহ বিভিন্ন দাবিতে আমাদের যে যুদ্ধ তাতে অনেকটা জয়ী হয়েছি। আমরা জাতীয় পতাকা, স্বাধীন সত্ত্বা ও একটি সংবিধান পেয়েছি। আর এর কৃতিত্ব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর।

সবশেষে, তিনি ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরপ্রতীক,বীরবিক্রমসহ সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
 
এমজেড/এমএস

আরও পড়ুন