পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ‘সোনালী ব্যাগ’ তৈরি কতদূর!
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ আবিষ্কার করেছিলেন বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী। পরে এই ব্যাগের নাম দেয়া হয় ‘সোনালী ব্যাগ’। সেই ব্যাগ তৈরির জন্য বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেয়া হয়। সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও আশা জাগানিয়া ও আলোচিত ‘সোনালী ব্যাগ’ এখনো সাধারণ মানুষের নাগালে আসেনি।
আবিষ্কারের পাঁচ বছর পরও পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের রাজ্যে হানা দেয়া তো দূরের কথা, দুয়ারে কড়াও নাড়তে পারেনি ‘সোনালী ব্যাগ’। এতে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে। বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাট থেকে ব্যাগ তৈরির প্রকল্প সফলই বলা যায়। তবে শেষ পর্যায়ে পাটের সেলুলোজ থেকে তৈরি শিট সেলাই করে ব্যাগ তৈরিতে জটিলতায় আটকে আছে সব। এটি একটি নতুন বিষয়। কোথাও মেশিন নেই। তাই বিভিন্ন দেশকে বিষয়টি বুঝিয়ে মেশিন তৈরি করতে হচ্ছে।
সফলভাবে শিট জোড়া দিয়ে ব্যাগ উৎপাদনে মেশিন পাওয়া গেলে বিজেএমসি বড় উৎপাদনে যেতে পারবে। বাণিজ্যিকভাবেও বেসরকারিখাতে ‘সোনালী ব্যাগ’ উৎপাদন শুরু হবে। তখনই সাধারণ মানুষের কাছে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ সহজলভ্য হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহমেদ খান ২০১৬ সালে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প তৈরি করেন। পরে তাকে বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার এই আবিষ্কার দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়।
‘সোনালী ব্যাগ’ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সুক্ষ্ণ সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি সোনালী ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।
পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ‘সোনালী ব্যাগ’ তৈরির পাইলট প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের ১২ মে। রাজধানীর ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে ব্যাগ তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মেশিনের সাহায্যে পাটের সেলুলোজ থেকে শিট তৈরি করা হয়। এরপর হাতে সেলাই করে শিট জোড়া দিয়ে ব্যাগ উৎপাদন করা হয়। সীমিত পরিসরে উৎপাদিত সেই ব্যাগ বিক্রিও করছে বিজেএমসি। প্রতিটি ব্যাগের দাম ১০ টাকা।
২০১৮ সালের ২ অক্টোবর পাট থেকে সোনালী ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যের কোম্পানি ফিউটামুরা কেমিক্যাল লিমিটেডের সঙ্গে বিজেএমসির একটি সমোঝতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। পরে আর এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি।
২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর জানিয়েছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব পাট থেকে তৈরি ‘সোনালী ব্যাগ’ বাজারজাত করবে সরকার।
২০১৯ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছিলেন শিগগির পাটের সোনালী ব্যাগ বাজারজাত করবে সরকার
‘সোনালী ব্যাগ’ কবে নাগাদ সাধারণ মানুষের নাগালে আসছে- জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাগ উৎপাদনের জন্য পাট থেকে শিট তৈরির কাজটি কমপ্লিট। বাস্তবতা হলো, এটি তৈরির জন্য সেভাবে মেশিনপত্র নেই। সেলুলোজ তৈরি করে বালতি দিয়ে নিয়ে ঢালা হচ্ছে। প্রথমে পাট কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়া হতো, এখন কাটিং মেশিন যোগ করা হয়েছে। সেই কাটিং মেশিন থেকে আবার নিচে ছিটকে পড়ে, সেখান থেকে উঠিয়ে দিতে হয়। পাট থেকে সোনালী ব্যাগ তৈরির কোনো অটোমেটেড মেশিন এখনো তৈরি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে মেশিন মোডিফাই করে আবিষ্কারক বিজ্ঞানী এই পর্যন্ত এসেছেন। শিট পর্যন্ত তৈরির ক্ষেত্রে আমরা সফল, এ কাজের জন্য যতখুশি দেশি মেশিনও আমরা নিতে পারব। এটা সফলভাবেই হয়ে গেছে। পরবর্তী স্টেপ হচ্ছে ব্যাগ তৈরি। এখন সেলাই করে ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। হাতে সেলাই করে তো ব্যাগ তৈরি করা যাবে না। কয়টা করব, সময় সাপেক্ষ।’
মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘আমাদের দেশে যে মেশিনগুলো দিয়ে পলিথিনের ব্যাগ তৈরি হয়, সেটি তাপে কাজ করে। কিন্তু তাপে তো এটা কাজ করবে না। তাপ দিলে এটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এডিটিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে হোক, যেভাবে হোক এটাকে জোড়া লাগিয়ে ফাইনালি ব্যাগ তৈরি করতে হবে। এডিটিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে এবং আলট্রাসাউন্ড দিয়েও জোড়া লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’
শিট কেটে ব্যাগ তৈরির মেশিন আনতে জাপান, জার্মানি ও চীনের সঙ্গে আলোচনা চলছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘তারা (দেশগুলো) বলেছে, এটা করা যাবে। আমরা বললে তারা মেশিন তৈরি করে আমাদের দেবে। এই মেশিন আমদানি করার পর্যায়ে আছি আমরা। একটি মেশিন এনে সেট করে একটা লাইনআপ প্রোডাকশন করতে পারলে, তখন হয়তো ব্যাপক উৎপাদনে যাওয়া যাবে। এর আগে তো সেটা হচ্ছে না।’
মেশিনের দাম ৩ থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে জানিয়ে আব্দুর রউফ বলেন, ‘এই ধরনের মেশিন তো পৃথিবীর কোথাও নেই। এই মেশিন সেট করতে পারলে আমাদের সর্বশেষ কাজটি কমপ্লিট হবে। একটি মেশিন এনে যখন আমরা দেখব সফলভাবে হচ্ছে। তখন আরও মেশিন সংগ্রহ করা যাবে। একটা ব্যাগের ১০ কেজি লোড নেয়ার কথা, কিন্তু আমরা যদি দেখি ৫ কেজি নিলেই ছুটে যাচ্ছে, তবে তো হলো না। তাই আমরা চাইলেই ১০০টি মেশিন সংগ্রহ করতে পারছি না। প্রথম একটা কিনে সফলভাবে কাজ হচ্ছে কি-না সেটা দেখতে হবে।’
গত মে মাসে পাট থেকে সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনে কাজ শুরুর কথা জানায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
‘সোনালী ব্যাগ’ তৈরির প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে পড়েছে কিনা- জানতে চাইলে এর আবিষ্কারক ও বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাগ তৈরির কার্যক্রম স্তিমিত হয়নি। আগের মতোই চলছে। পাইলট প্রজেক্টের আওতায় এখন আমাদের এক টন ব্যাগ তৈরির ক্যাপাসিটি হয়েছে। এখন প্রসেসটা ডেভেলপ করতে হবে। এটাকে বড় পরিসরে চাইলে বা বাণিজ্যিকভাবে কোনো উদ্যোক্তা উৎপাদন করতে চাইলে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমাদের পাইলট প্রজেক্ট ডান (হয়ে গেছে), আমার মেশিনপত্র চলছে, একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।’
শিট থেকে ব্যাগ তৈরির জটিলতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেজন্য মেশিনপত্র আনা হচ্ছে। পৃথিবীতে সব জিনিস তো রেডি থাকে না। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে তৈরি করে। এটা তৈরি করতে সময় লাগছে। অনেক জটিলতাও আছে। একটা কোম্পানির সঙ্গে কথা বললাম কিন্তু তারা অগ্রিম টাকা চায়। সরকার কী কোনো মেশিন না কিনে টাকা অগ্রিম দিতে পারে? এখানে তো জটিলতা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চীনের একটা কোম্পানিকে কিছু স্যাম্পল পাঠিয়েছিলাম, তারা ব্যাগ বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে মেশিন ডিজাইন করে দিতে পারবে। আরও অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু তারা অ্যাডভান্স চায়, এমওইউ করতে চায়। তখনই আমাদের দমে যেতে হয়।’
‘এছাড়া গত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারি যাচ্ছে। তারা (বিদেশিরা) বলছে আমাদের সঙ্গে এসে মিটিং করো, তারা বাংলাদেশে আসবে না। যতই ভার্চুয়ালি মিটিং করি সরাসরি দেখা সাক্ষাৎটাও জরুরি। করোনা না থাকলে হয়তো এতদিন অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম’, যোগ করেন এই বিজ্ঞানী।
মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘যা (সোনালী ব্যাগ) বানাচ্ছি, সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে। বিদেশিরাও নিচ্ছে। অনেকে বিপুল সংখ্যক চাইছে, আমরা দিতে পারছি না। ২-৪ হাজার চাইলে আমরা দিতে পারছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কোরবানিকে সামনে রেখে এক লাখ ৩০ হাজার করে চাইছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চাইছে। আমরা তো ৪/৫ লাখ ব্যাগ বানাতে পারছি না। গার্বেজ ব্যাগগুলোও অনেক বড়।’
বিজেএমসির এই বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘জলবায়ু তহবিলের টাকায় আরও একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, এর মাধ্যমে গবেষণা হবে। ব্যাগের দাম কীভাবে আরও কমানো যায়, সেই বিষয়গুলো দেখা হবে।’
আরএমএম/এমআরআর/এএসএম