ব্যাটারিচালিত যানবাহন সড়কে ফেরাতে আন্দোলনের ভাবনা চালকদের
ব্যাটারি বা ইঞ্জিনচালিত রিকশা-অটোরিকশা বন্ধে এর আগে কোনো বড় উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করেছে এসব যানবাহন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও চালকরা ফের রাস্তায় নেমেছেন।
চলমান লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এ যানগুলো হয়ে উঠেছে যাত্রীদের প্রধান বাহন। গত ২০ জুন এ ধরনের যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে চালকদের একাধিক সংগঠন।
সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বড় কর্মসূচির চিন্তাভাবনা করছেন তারা। অন্য সময় ‘আশ্বাস’নিয়ে ফিরে গেলেও সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও ব্যাটারিচালিত যানের লাইসেন্স দেয়ার দাবিতে সারাদেশে বড় ধরনের বিক্ষোভের জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের এক সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রিকশা-ভ্যানের মধ্যে মোটর লাগিয়ে রাস্তায় চলছে। শুধু সামনের চাকায় ব্রেক, পেছনের চাকায় কোনো ব্রেক নেই বা ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল। সেগুলো যখন ব্রেক করে যাত্রীসহ গাড়ি উল্টে যায়। হাইওয়েও এ রিকশা চলে। এজন্য সারাদেশে এই ধরনের রিকশা-ভ্যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
ইজিবাইক, নছিমন, করিমনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ বিভিন্ন শহরে অটোরিকশা চলছে। আমরা সব জায়গায় যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারিনি। শিগগিরই এটাকে পরিমিত করা এবং ফাইনালি বন্ধ করা যায় কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা সেখানেও কাজ করব।’
জানা গেছে, গণসংহতি আন্দোলন, রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিচালক সংগ্রাম পরিষদ, রিকশা-ভ্যান সমিতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ঐক্য পরিষদসহ একাধিক সংগঠনের ব্যানারে রাস্তায় নামতে চান চালকরা।
মহাসড়ক ব্যতীত স্থানীয়ভাবে অবিলম্বে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালুর দাবিতে গত ২৭ জুন প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সংগঠনগুলো। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী সংগঠনের কয়েকজন নেতা।
সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশে এ ধরনের যানের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনগুলো।
রিকশা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘মহামারিতে মানুষ তার রুটি-রুজির বন্দোবস্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বাতিলের মাধ্যমে নতুন করে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা বিপদের সম্মুখীন করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। শোনা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে নতুন ধরনের রিকশা আমদানির প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার এবং এ কারণেই ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বাতিল করা হয়েছে। অবিলম্বে সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।’
রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্রেক পদ্ধতি বা তার কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দুর্ঘটনা হয় বলে তা রাস্তা থেকে উচ্ছেদের কথা বলছেন। কিন্তু সেই কাঠামোগত দুর্বলতা কাটানোর কোনো সুপারিশ না করে রাস্তা থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত অনেকটা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৮ বছর ধরে নকশা আধুনিকায়ন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ যান্ত্রিক যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছি।’
লিপন আরও বলেন, ‘গত দেড় বছরে করোনাভাইরাস মহামারি ও টানা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত নানা পেশার শ্রমিক এবং কর্মহীন, বেকার ও ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। মহামারিতে নতুন করে আরও আড়াই কোটি মানুষসহ দেশের ৫০ ভাগের ওপর মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, তখন লাখ লাখ রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন চালককে বেকার ও কর্মহীন করার চক্রান্ত চলছে। এই যান একেবারে বন্ধ না করে নকশা আধুনিকায়ন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ যান্ত্রিক যানবাহনের লাইসেন্স দিতে হবে।’
২০১৫ সালের ১ আগস্ট ২২টি জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে মালিক-শ্রমিকদের প্রতিবাদে মহাসড়কে নৈরাজ্য দেখা দেয়। ২০১৭ সালে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন অলি-গলিতে এখনও চলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা। সর্বশেষ ২০ জুন ফের এ ধরনের যানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেল সরকার।
ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ১৩ হাজার মোটরচালিত রিকশা ও ভ্যান ধ্বংস করা হয়েছে। ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে। এ যানগুলো যেন নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বের হতে না পারে বা হাইওয়ে, বড় রাস্তায় না আসতে পারে সেজন্য তদারকি চলছে।
প্যাডেলচালিত রিকশায় বেড়েছে ভাড়া
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার উপস্থিতি কমে যাওয়ার সুযোগে ২০-৩০ টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছেন প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরা। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এসব রিকশার কদর বেড়েছে। সুযোগ বুঝে অতিরিক্তি ভাড়া হাঁকছেন চালকরা, এমনটাই অভিযোগ যাত্রীদের।
সাধারণত মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৫০ টাকা হলেও, এখন রিকশাচালকরা ৭০-৮০ টাকার নিচে যেতে চাইছেন না বলে জানিয়েছেন গার্মেন্টস কর্মী মাহমুদ হাসান।
তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস তো বন্ধ নয়। আমাদের পরিবহনও দিচ্ছে না। আগের লকডাউনে এত ভাড়া ছিল না। এখন রিকশাচালকরা বেশি ভাড়া চাইছেন।’
মেডিকেলছাত্রী মুনিরা জানান, নিউমার্কেট থেকে শাহবাগ ১০০ টাকা ভাড়া চাইছেন চালকরা। এ ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে পদক্ষেপ দাবি করেন তিনি।
‘অনিরাপদ’বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনকে ত্রুটিযুক্ত বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ রিকশাগুলো দুর্ঘটনা ঘটায়। কারণ এসবের নিজস্ব স্ট্যাবিলিটি অনেক কম, ব্যালেন্সিং নেই। এসবে ব্রেকিং নেই, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার জন্য এরা দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘রিকশার মধ্যে ইঞ্জিন লাগানো। এতে আসলে নতুন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসবে খুব বেশি স্ট্যাবিলিটি আনার সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এগুলো তো মোটরযান আইনে নিষিদ্ধ যানবাহন। আমরা অনেকবারই এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু কেউ কোনো কর্ণপাত করেনি। এটা সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি যানজটের জন্য দায়ী। রিকশা উচ্ছেদের পাশাপশি এ ধরনের যানের আমদানি বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব জায়গায় এ ধরনের যান একমাত্র যান হিসেবে দাঁড়িয়েছে সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ যানকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে নারাজ রিকশা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘এটা আসলে ভুল ধারণা। এটা যদি ঠিকমতো চালানো হয় তাহলে দুর্ঘটনা কম হবে।’
রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে তিনদিনের সময় চেয়েছিল। লকডাউন হওয়ায় নতুন করে কিছু জানায়নি। বিভিন্ন জায়গায় এ রিকশা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে, রিকশা চালকদের ধরা হচ্ছে বলে জানতে পারছি। কাজ হারিয়ে এ ধরনের রিকশা চালকরা অনাহারে দিনযাপন করছেন।’
নিষেধাজ্ঞার পরও সড়কে যেভাবে চলে এসব যান
২০১৫ ও ২০১৭ সালে দুই দফা নিষেধাজ্ঞার পরে সড়কে চলছে এসব ব্যাটারিচালিত যান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি বন্ধ না করা ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এমনটা হচ্ছে। একদিকে সড়কে প্রচুর ব্যাটারিচালিত যান রয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন জায়গায় গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এ যানগুলো বিকল্প হয়ে উঠেছে।
রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, ‘২০১৫ সালে একবার তুলে দিয়েছিল। ২০১৭ সালেও একই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও এই যানগুলোকে পুরোপুরি উঠানো যায়নি। এ রিকশার সঙ্গে কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। আবার অনেক জায়গায় গণপরিবহন ঠিকমতো নেই। আসলে পুরোপুরিভাবে এ ধরনের যান ওঠানো সম্ভব নয়। এখন সারাদেশে চলছে। কোনো ধরপাকড় নেই। কিন্তু রাজধানীতে ধরপাকড় চলছে।’
দেশি একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশি তিন চাকার গাড়ি সড়কে নামাতে চায়। এতে সরকার তাদের সাহায্য করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
নাদিম বলেন, ‘নতুন একটি কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দিতে সোলারের একটি গাড়ি সড়কে নামাতে চায় বড় একটা ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ কারণে সরকার এ ধরনের যান সড়ক থেকে সরাতে চায়। ব্যাটারিচালিত যে রিকশা এখন সড়কে আছে সেটা কিনতে খরচ হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অন্যদিকে নতুন যে গাড়িটি আসছে সেটাও তিন চাকার কিন্তু সেটার দাম ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। প্রকৃত রিকশাচালকরা আসলে সেই গাড়িটা কিনতে পারবে না। ফলে নতুন গাড়ি মার্কেটে আনতে হলে পুরনো গাড়িটিকে মার্কেট থেকে সরাতে চায় সরকার। আমাদের দেশে প্রায় মন্ত্রীই ব্যবসায়ী। এ কারণে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিতে চায় সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার বাইরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে দিলেও রাজধানীসহ বেশকিছু সড়কে তারা চলতে দেবে না।’
‘লুকিয়ে, লুকিয়ে’ রিকশা চালান রমজান
মিরপুর-১০ নম্বরে কথা হয় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক রমজানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে মিরপুরের প্রশিকা মোড় থেকে আগে রিকশা ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ৪ হাজার টাকা নিয়ে ৮ দিন পর ফেরত দেয় তারা।’
রমজান বলেন, ‘আগে বাস চালাতাম। শারীরিক সমস্যার কারণে এখন আর পারি না। বাধ্য হয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাই। কিন্তু পুলিশের ভয়ে আর মূল সড়কে যেতে পারি না। বিভিন্ন অলি-গলিতে ভয়ে ভয়ে চালাতে হয়।’
রিকশার আধুনিকায়ন সম্ভব
মিরপুরের এমআইএসটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট ব্যাটারিচালিত রিকশার আধুনিয়কায়নে কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। রিকশা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রিকশাকে উপযোগী করে গতি কমানোর যন্ত্র তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। এগুলো ব্যবহার করে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে নিরাপদ করা যায়। রিকশা আধুনিক করার জন্য দেশীয় প্রযুক্তি করা আছে। কিন্তু সরকার সেটা নিচ্ছে না।’
এসএম/এসএস/এএসএম