ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে খাসিয়াপল্লী

সালাহ উদ্দিন জসিম | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে | প্রকাশিত: ১০:২৪ এএম, ০৭ জুলাই ২০২১

‘স্যার, দয়া করেন, ঘরটা দেন’। ঢাকা থেকে যাওয়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে এমন আকুতি ঝরছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম আশিদ্রোনের খাসিয়াপল্লীর বিধবা মেরি বংয়ের (৬০)। তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই মেরি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন তার জীবনযুদ্ধের গল্প। জানিয়েছেন একমাত্র স্বপ্নের কথা—শেষ জীবন কাটাতে সরকারের কাছে একটি ঘর চান।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে হোসনাবাদ টি স্টেট পেরিয়ে আশিদ্রোন গ্রাম। চা বাগানের মাঝ দিয়েই চলেছে সড়ক। কিছু পাকা কিছু কাঁচা মাটির রাস্তা। সড়ক যেন চলে গেছে টিলা ভেদ করে। চান্দের গাড়িতেও যেন গা ছম ছম করে। সূর্যের আলোকরশ্মি মিলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সবুজ প্রকৃতি যেন পূর্ণ রূপলাবণ্য তুলে ধরেছে। পরিবেশটা যুৎসই অতিথি স্বাগত জানানোর।

নয়া অতিথি হিসেবেই কর্মকর্তা-সাংবাদিকদের প্রবেশ আশিদ্রোন খাসিয়াপল্লীতে। চা বাগান পেরিয়ে পানের বরজের মাঝখানে ছোট্ট গ্রাম। স্কুলের সাইনবোর্ড দেখে সহজেই বোঝা যায় গ্রামের নাম-পরিচয়। স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে ৮-১০ শিশু। এ শিশুদের নেতৃত্বে অর্ণিকা সুরং (২৬) নামের একজন। প্রথম দর্শনে তাকেও শিশুর মতোই মনে হয়। যদিও তিনি তাদের শিক্ষক। প্রথমে ইংরেজিতে কথা বললেন, পরে কিছুটা বাংলায়। অর্ণিকা শিশুদের নিয়ে খাসিয়া ভাষায় গান গেয়ে ঢাকাই অতিথিদের স্বাগত জানান। পরে তার স্কুল ঘুরে দেখান।

অর্ণিকা সুরংয়ের জন্ম এই খাসিয়াপল্লীতেই। পড়াশোনা করেছেন তাদের আদি নিবাস ভারতের শিলংয়ে। এইচএসসি পাস এ তরুণী অনর্গল ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন। আর্থিক সংকটের কারণে আর পড়া হয়নি। ফিরে এসেছেন নিজ গ্রামে। স্বজাতির একজনের সঙ্গে পরিণয়ও হয়েছে। রয়েছে ফুটফুটে ৫-৬ বছরের একটি সন্তানও। নিজের সন্তানসহ ৩০-৩৫ শিশুকে খাসিয়া ভাষা শেখান। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন-সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) প্রকল্পের কিছু অর্থায়ন আর নিজেদের উদ্যোগে স্থাপিত ৬নং হোসনাবাদ খাসিয়াপুঞ্জি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি।

অর্ণিকা সুরং জানান, এক সময় এই পল্লী ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকারে। বিদ্যুৎ ছিল না। গাছপালাসহ চারদিকের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ বাইরের লোকদের কাছে মনোমুগ্ধকর হলেও তাদের জন্য ছিল অভিশাপ। মেয়েদের জন্য স্কুলে বা গঞ্জে যাওয়া নিরাপদ ছিল না। ছিল না রাস্তাঘাটও। বৃষ্টিতে কাদামাটি একাকার হয়ে থাকত। চলাচলের অনুপযোগী থাকত সড়ক। এখন বিদ্যুৎ এসেছে, সড়কও সংস্কার হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ব্রিজও হয়েছে। সবার যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে স্কুলগামী মেয়েদের বাইসাইকেল দিয়ে সরকার এ জনপদের জীবনযাত্রার ধরনই পাল্টে দিয়েছে। এটি এখন অর্ণিকাদের বদলে যাওয়া নতুন এক খাসিয়াপল্লী!

jagonews24

অর্ণিকার মা বেলি সুরং (৫৫) জাগো নিউজকে বলেন, ‘পান কুচি করে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করি। আমাদের রুজি কম। এজন্য ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাইতে পারি না। তার পরও অনেক কষ্টে মেয়েটাকে শিলং পাঠিয়ে কিছু (এইচএসসি) পড়াশোনা করাইছি। এখন আর পারি না। বিয়ে দিছি। এখানে (বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে) পড়ায়।’

স্যার, দয়া করেন, ঘরটা দেন
খাসিয়া নারী মেরি বংয়ের (৬০) স্বামী মারা গেছেন প্রায় ১৮ বছর। পান চাষ করেই দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার চালান। মেয়ে ও এক ছেলে এইচএসসি পাস করেছেন। অর্থ সংকটে আর পড়াতে পারেননি।

তিনি জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, মেয়ের জন্য বাইসাইকেলসহ নানা সুবিধা পেয়েছেন। এখন ঘরটা ঠিক করতে চান। সরকারের কাছ থেকে একটা ঘর পেলেই তিনি খুশি। তাই তো ঢাকা থেকে পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তা-সাংবাদিকদের দেখে বলেই ফেলেছেন, ‘শুনেন স্যার, দয়া করেন। ঘরটা দেন।’

জায়গাটা যদি নিজের হয়, অনেক খুশি হবো
খাসিয়া তরুণ রোনালদো সুরং (১৮) পড়াশোনা করেছেন দশম শ্রেণি পর্যন্ত। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পড়াশোনা আর হচ্ছে না। এখন পান চাষে বাবা-মাকে সহায়তা করেন। মাসে ৫-৬ হাজার টাকা আয় হয়। শ্রমিকদেরও দিতে হয়। কোনো রকম কষ্টে জীবন কেটে যায়।

এ এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে এসেছে বিদ্যুৎ, এরপর রাস্তাঘাট ও স্কুল হয়েছে। এই পুঞ্জিতে থাকি কোম্পানির জায়গায়। আমরা ট্যাক্স দিয়ে থাকি। এ জায়গাটা যদি আমাদের নিজের হয়, অনেক খুশি হবো। তাতে আমাদের ট্যাক্স দিতে হবে না। আমরা চাই, আমরা নিজের জায়গায়ই থাকবো। এটাই আমাদের চাওয়া।’

এ সরকার থাকলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে
খাসিয়াদের নেতা (মন্ত্রী হিসেবে খ্যাত) ওয়েল সুরং জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আগে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতাম। রাস্তাঘাট ছিল না। কেউ অসুস্থ হলে তাকে ভারে (কাঁধে) করে (চিকিৎসার জন্য) নিয়ে যেতাম। পাঁচ বছর আগে এসেছে বিদ্যুৎ, তিন বছর আগে সিঁড়ি দিয়েছে সরকার। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, স্কুল দিয়েছে। ঘরবাড়ি দেবে বলেছে। এ সরকার আমাদের প্রতি সুনজর দিয়েছে। এ সরকার আরও পাঁচটা বছর থাকলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে।’

jagonews24

তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের প্রাইভেট (প্রাইমারি) স্কুল। আমাদের মিশন থেকে কিছু সহযোগিতা ও নিজস্ব কিছু অর্থায়নে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি। ৩০ জন শিক্ষার্থী। এখানে দুজন শিক্ষক আছেন। একজন খাসিয়া, একজন বাঙালি। সকালে বাংলা বিকেলে খাসিয়া ভাষা শেখানো হয়। আমরা নিজেদের তরফ থেকে চাল-চাঁদা তুলে এই শিক্ষকদের দিচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে ২৫ টাকা দেই। এই টাকায় তো হবে না। এটার উন্নতির জন্য আরও বাড়াতে হবে।’

‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বজাতির ভাষা শিক্ষার বই দিয়েছেন। এটা দিয়ে পড়াচ্ছি। আমি খুব আনন্দিত, যে ভাষা নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম, চিন্তা করতাম। এ ভাষা শিখতে ভারতে গিয়ে লেখাপড়া করাতাম। এখন আর আমাদের ভারতে যেতে হবে না। আমাদের এখানেই হয়ে গেছে। আমি অত্যন্ত খুশি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ যে এ মূল্যবান জিনিসটা আমাদের স্কুলে পৌঁছাইছেন।’

ওয়েল সুরং বলেন, ‘ভাষা মানুষের রক্ত দিয়ে আনতে (অর্জন করতে) হয়। শেখ হাসিনার সরকার আমাদের কাছে বিনামূল্যে, বিনাশ্রমে, বিনা রক্তপাতে ভাষা পৌঁছে দিয়েছেন। এটা অনেক বড় পাওয়া।’

শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমন্বয়কারী তাজুল ইসলাম জাবেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে ১২টি খাসিয়াপল্লী, ১৫টি গারোপল্লী, ৪২টি চা বাগান রয়েছে। এখানে প্রতি বছর প্রধানমন্ত্রীর অর্থায়নে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হয়। আমি সেগুলো মনিটরিং করি। তাদের যা প্রয়োজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়ে লিখিত দেই, তিনি ব্যবস্থা করেন।’

তিনি বলেন, ‘তারা (খাসিয়া) অনেক পিছিয়ে ছিল। যোগাযোগ ছিল না। যাতায়াত ভালো ছিল না। ১২ বছরে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১০টি ব্রিজ, আটটি সিঁড়ি, আরসিসি ঢালাই রাস্তা, পাঁচটি বড় ব্রিজ সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর অর্থায়নে করে দিয়েছি। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি তাদের যাতায়াতে দুটি গাড়িও দিয়েছি। এছাড়া প্রতি বছর ৫০ জন স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বাইসাইকেল দিয়ে থাকি। এ পর্যন্ত ২৩০টি বাইসাইকেল দেয়া হয়েছে। শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি সেলাই মেশিনও দিয়েছি। এখন তারা পান চাষ করার পাশাপাশি নিজের কাপড় নিজেরা সেলাই করে পরতে পারে।’

ভূমির মালিকানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা যেখানে থাকে, সেটা সম্পূর্ণ খাসজমি। এটা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজ করছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা যেতে পারে।’

খাসিয়াদের প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ ও খাসিয়াদের জমির মালিকানা দেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (নির্বাহী সেল) আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কাজ করি। তার মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি, প্রশিক্ষণ, ঘর করে দেয়াসহ নানা বিষয় রয়েছে। সেগুলো অব্যাহত থাকবে এবং আরও বিস্তৃত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা এবং জমির মালিকানা দেয়ার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রস্তাবনা এলে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবো।’

উল্লেখ্য, আশিদ্রোন ইউনিয়নে ৫০টি খাসিয়া পরিবারের বাস। ১৮০ একর লিজ নেয়া জমিতে পান চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। এভাবে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ২০-২৫ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে। তাদের দাবি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ভোটাধিকার দিয়েছেন, তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন তাদের জমির মালিকানাসহ ঘর দেন।

এসইউজে/এইচএ/এএসএম