ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

স্বচ্ছ জলধারায় শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ

প্রকাশিত: ০৪:১২ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তাল সারাদেশ। যুদ্ধ শুরু হয়েছে পুরোদমে। সেই দিন সকাল গড়িয়ে নামে দুপুর। ঝিকঝিক করছিল রাঙামাটির সবুজ পাহাড় ঘেরা কাপ্তাই হ্রদের শান্ত নীল জলরাশি। ঠিক তখনই হঠাৎ শত্রু বাহিনীর কামান ও মর্টারের আওয়াজ গর্জে ওঠে। গর্জনে প্রকম্পিত হচ্ছিল শান্ত পাহাড়ি জনপদ। বুকে হাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এমনই বর্ণনা করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী দয়াল কৃষ্ণ চাকমা।  

তিনি বলেন, সেই দিন গোলাগুলির শব্দে গর্জে ওঠে আকাশ, বাতাস। হ্রদের জলে সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন। পাক হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্য রাঙামাটি শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে নানিয়ারচরের বুড়িঘাটের চেঙ্গীখালের তীরে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দখল করা। চেঙ্গীখাল বরাবর উত্তর-দক্ষিণ কোণে হ্রদের ছোট্ট একটি দ্বীপে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা ব্যূহটি গড়ে তোলেন। সেখানে শত্রুপক্ষের গতিবিধি নির্ণয়ে মেশিনগানার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন তৎকালীন অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল ও ইপিআরের (ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্য ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ।

সেই যুদ্ধের বর্ণনা উল্লেখ করে দয়াল কৃষ্ণ চাকমা বলেন, সবার আগে মুন্সী আবদুর রউফের দৃষ্টি রেখার দিগন্তে ধরা পড়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছিল পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত রণতরী। পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের কোম্পানির অধিক সৈন্য ৬টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র সহকারে তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোটযোগে প্রবেশ করে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে। ওই সময় মর্টারশেল এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্ত ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ নিজ অবস্থানে সুদৃঢ় থেকে শত্রু পক্ষের ওপর তার মেশিনগান দিয়ে প্রবল গোলা বর্ষণ করতে থাকেন। তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেন। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়েন পরিখা থেকে। উপভোগ করতে থাকেন বিজয়ের আনন্দ অনুভূতি।

Rangamate

ওই সম্মুখযুদ্ধে মুন্সী আবদুর রউফ নিজের মেশিনগান তুলে ধরে অনবরত গুলি ছুঁড়তে লাগলেন সরাসরি শত্রুদের বোট লক্ষ্য করে। তার অসীম সাহস ও মেশিনগানের প্রবল গোলার আঘাতে শত্রু পক্ষের ২টি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোটসহ দুই প্লার্টুন শত্রু সৈন্যের সলিল সমাধি হয়। বাকি দুই প্লার্টুন সৈন্য দ্রুত পিছু হটতে থাকে এবং মুন্সী আব্দুর রউফের ওপর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে। এতে হঠাৎ পাক হানাদারদের একটি মর্টারের গোলা তার ওপর আঘাত করলে সেখানেই ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ শাহাদাৎ বরণ করেন। সেই দিন রণাঙ্গনে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন দয়াল কৃষ্ণ চাকমা।

বুড়িঘাট এলাকার অধিবাসী দয়াল কৃষ্ণ চাকমা বলেন, শাহাদাৎ বরণের পর দিন শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের মরদেহ দেখতে পেয়ে তিনি নিজ হাতে তা সমাহিত করেন। কিন্তু তখন তিনি জানতেন না এ শহীদ বীরযোদ্ধাই মুন্সী আব্দুর রউফ। তিনি শুধু জানতেন একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হওয়ার ঘটনা।

এদিকে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার সহযোগিতায় সমাধিস্থল শনাক্তের পর ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সী আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্মৃতিসৌধটি ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ রাইফেলসের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আজিজুর রহমান।  

বিশ্লেষকদের মতে, শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের আসীম সাহস ও প্রবল প্রতিরোধের মুখে সেদিন শত্রুবাহিনী মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তার সেই আত্মবিসর্জন, কর্তব্য পরায়ণতা ও দেশ প্রেমের বীরত্বগাথা অবদানের কথা তুলে ধরতে হবে। ধরে রাখতে হবে তার সেই গৌরবগাথা স্মৃতি। মহান স্বাধীনতার জন্যে আত্মজীবন বিসর্জন দিয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদানের ফলে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে। তার সেই অবদানের কথা স্মরণ করতে হবে জাতিকে। আর দয়াল কৃষ্ণ চাকমার কর্তব্য ও মহানুভবতাকেও সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে হবে রাষ্ট্রকে।

সূত্র মতে, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মুন্সী মেহেদী হোসেন ও মাতার নাম সৈয়দা মুকিদুননেছা বেগম। তিনি ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ সৈনিক পদে যোগদান করেন। তার সৈনিক নম্বর ছিল ১৩১৮৭।

এসএস/এমএস